বাংলা কবিতার আধুনিক হয়ে ওঠা ইংরেজি কবিতার হাত ধরেই।ইংরেজি রোমান্টিসিজম, ক্লাসিসিজম, ন্যাচারালিজম, রিয়ালিজম, স্যুরিয়ালিজম, স্ট্রা কচারালিজম, মডার্নিজম, পোস্ট-মডার্নিজম এবং ডি- কন্সট্রাকশান বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক বাংলা সেরা কবিরা ছিলেন আধুনিক ইংরেজি কবিতার সঙ্গে সুপরিচিত। ফলে বাংলা কবিতা বিবর্তিত হয় খুব দ্রুত। কিন্তু যে ইংরেজি কবিতার হাত ধরে বাংলা কবিতার এই উন্নতি, তার কিন্তু ছন্দের এত বিভিন্নতা নেই। পুরানো পয়ার, ত্রিপদী ছাড়াও বাংলা কবিতার মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত এই তিন ছন্দ বাংলা কবিতাকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে।সেখানে ইংরেজি কবিতাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এক আয়েম্বিক পেন্টামিটার নিয়েই।এর কারণ, বাংলা এসেছে সংস্কৃতের মত ভাষা থেকে যার ছিল গায়ত্রীর মত মহাজাগতিক ছন্দ। অবশ্য এ কথাও মানতে হবে হিন্দি, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষাও সংস্কৃত থেকেই এসেছে। কিন্তু একমাত্র বাংলা কবিতাই এত বিভিন্ন সুরেলা ছন্দে ছন্দিত। এর কারণ অবশ্যই বাঙালীর আজন্ম কবিতার প্রতি ভালবাসা।
কিন্তু চোখ নয়, কান। কানের উপরেই নির্ভর করতে হবে ছন্দের জন্য। ছন্দ আসলে গানের মতই শোনার জিনিস।
আমি বিশ্বাস করি ছন্দ শেখা মোটেই শক্ত কাজ নয়। মাত্র পাঁচ দশ দিনেই ব্যপারটা শিখে নেওয়া যেতে পারে।
ছন্দ শিখতে গেলে সিলেবেল বা দল সম্পর্কে একটু খেয়াল রাখতে হবে। শুধু সিলেবেল গুণেই আপনি দলবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দটা শিখে নিতে পারবেন।আসুন আমরা সিলেবেল গুণি। ‘সিলেবেল’ এই শব্দে কটি সি -লে -বেল আছে? ৩ টি। অক্ষর যদি ও ৪ টি। কিন্তু ‘বেল’ শব্দটি আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করি। তাই বেল শব্দে একটি দল বা সিলেবেল। এবার ধরুন ‘ছন্দ’ শব্দটিকে। সিলেবেল আছে ২ টি। ছন্ এবং দ। বাতাস এ ৩ টি অক্ষর থাকলেও সিলেবেল আছে ২ টি। বা এবং তাস।
এবারে আলোচনার প্রথম বাক্যটাকে ধরুন। ‘আমি বিশ্বাস করি ছন্দ শেখা মোটেই শক্ত কাজ নয়।’ এখানে কতগুলো সিলেবেল আছে? আমি তে ২, বিশ্বাস এ- বিষ এবং শ্বাস – ২, করি- ২, ছন্দ- ২, শেখা- ২, মোটেই- মো এবং টেই -২, শক্ত- শক্ ও তো -২, কাজ-১, নয় -১ । মোট- ২+২ +২+২+ ২+২ +২+১+১=১৬ টি সিলেবেল।
এবারে ধরুন ‘ তোমরা যাবে নাইট ক্লাবে পরবে ফাটা জিন্স’ লাইনটিকে। কটি সিলেবেল?
তোমরা যাবে- ৪ টি, নাইট ক্লাবে- ৪ টি, পরবে ফাটা- ৪ টি, জিন্স-১ টি।
অর্থাৎ, বাক্যটিতে মোট ৪+৪+৪+১ মোট ১৩ টি সিলেবেল আছে।
এবারে সারা দিন আপনার নিজের খুশি মত যে কোনও শব্দ নিন আর তাতে কটি সিলেবেল আছে তা মনে মনে ভাবুন। কোনও কবিতা লেখার চেষ্টা না করে শুধু শব্দ আর সিলেবেল কাউন্ট করুন।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা নাচিয়ে-গাইয়ে আমরা যা-ই হতে চাই না কেন দরকার হয় নির্দিষ্ট শিক্ষা বা কোর্স ওয়ার্কের। এমন কি সাধারণ রাজমিস্ত্রি হতে গেলেও নিতে হয় শিক্ষা। ব্যতিক্রম একমাত্র কবিতা। কবিতার জন্য প্রথাগত ক্লাসের ব্যবস্থা নেই কোথাও। ফলে যারা কবিতা লেখেন তারা শুধু হাতড়ে মরেন কানাগলির এদিক ওদিক।এখানে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তোলা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। ছন্দ কবিতার সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ একটি অঙ্গ। সুর যেমন গানের, ছন্দ ও তেমন কবিতার। এই ছন্দটিকে খুব ভালো করে রপ্ত না করতে পারলে কবিতা উপযুক্ত মানে যেতে পারে না কোনও দিনও। বাংলা ছন্দ শিখে , ছন্দে কবিতা লেখা খুবই শক্ত কাজ।এজন্য দরকার দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও সাধনার। একটু সতর্ক হলেই কিছুটা অন্তত শিখতে পারেন যে কেউ।
১.স্বরবৃত্ত ছন্দ
বাংলা কবিতার তিনটি প্রধান ছন্দ।স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত তাদের একটি।
এর আগে দল বা সিলেবল বিষয়ে আলোচনা করেছি।দল বা সিলেবল হল ছন্দের প্রাণ।আর ছন্দে চোখের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কান।তাই কোনো লাইন দেখতে ছোট বা বড় হলেই সেটা বেমানান নয়, কান যদি বেমানান বলে, তবে সেটাই শুনতে হবে।
দল দুই প্রকার।মুক্তদল আর রুদ্ধদল।স্বরবৃত্ত ছন্দে সব দল সমমাত্রিক। কোনটা মুক্তদল, আর কোনটা রুদ্ধদল? কি করে চিনব?
খুব সহজ।যে দলের শেষে স্বরবর্ণ থাকে সেটাই মুক্তদল।আর যে দলের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে সেটা রুদ্ধ দল।
যেমন - 'বাজনা বাজে' বাক্যাংশটিতে বাজ, না, বা, জে এই চারটি দল আছে।এর মধ্যে প্রথমটি হল রুদ্ধ দল।বাকিগুলো মুক্ত দল।
বাজ্+ না+বা+জে = ১+১+১+১= ৪ মাত্রা।
স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে গেলে কোনটা কোন দল, সেটাও জানার দরকার নেই।শুধু দলের বা সিলেবেলের ধারনাটুকুই যথেষ্ট একদম ঠিকঠাক ছন্দ মেনে স্বরবৃত্তে লেখার জন্য।
এবারে দেখা যাক কিভাবে লেখা হবে।
কবিতার প্রথম লাইনটাই আপনাকে বলে দেবে কবিতাটা কোন ছন্দে লেখা হবে।কারণ, এটা বলা হয়, first line comes from God!
যদি প্রথম লাইনটা স্বরবৃত্ত ছন্দে আসে তো পুরো কবিতাটা স্বরবৃত্ত ছন্দেই লেখা উচিত।নইলে ভাতের বদলে খিচুড়ি রান্না হয়ে যাবে।
এবারে প্রশ্ন, কি করে বুঝব, প্রথম লাইনটা কোন ছন্দে এসেছে?
এটা একটু শক্ত।তিন ছন্দ সম্পর্ক এ প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এটা বের করা শক্ত।
যদি দেখা যায় তিন অক্ষরের শব্দের পাশে তিন অক্ষরের শব্দ এসে বসেছে, তাহলে আন্দাজ করা যেতে পারে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আসছে।যেমন -' হাজার বছর ধরে আমি পথ...' এমনি প্রথম লাইন মনে এলে বুঝতে হবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে।সেখানে নিয়ম হবে বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়।অর্থাৎ তিনের পাশে তিন, দুই এর পাশে দুই অক্ষরের শব্দ।
যদি দেখা যায় প্রথম লাইনে যুক্তাক্ষর যুক্ত শব্দ এসেছে, বা লাইনটা মধ্যম লয়ের তাহলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে ধরতে হবে।যেমন, 'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল' এমন প্রথম লাইন এলে ধরে নিতে হবে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে আসছে।
আর যদি দেখা যায় লাইনটা খুব দ্রুত পড়া যাচ্ছে, ছড়ার মত দোলা আছে, তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে বুঝতে হবে।
আজ শুধু স্বরবৃত্ত ছন্দের আলোচনা করছি।তিন ছন্দের আলোচনা পড়ার পরে এই ব্যপারটা ধরতে পারা সহজ হবে।বাস্তবিক, প্রথম লাইনটা দেখে এই ধরতে পারাটা বেশ শক্ত।এর জন্য দরকার ছন্দের নিয়ম মেনে কবিতা পাঠের সঙ্গে ছন্দ পাঠ।আসলে ছন্দপাঠ খুবই আনন্দদায়ক।ছন্দপাঠ করতে শেখা কবি হবার জন্য জরুরি। এমনকি গদ্য কবিতা লেখার জন্যেও।গোটা সংস্কৃত সাহিত্য গদ্যে লেখা, কোথাও অন্তমিল নেই, কিন্তু কি স্পন্দন! কি স্পন্দন!অন্তমিল অনেক সময় কবিতার ভাবকে দুর্বল করে, কিন্তু ছন্দের স্পন্দন হল কবিতার প্রাণ। তাই ছন্দকে ছুঁড়ে ফেলা শক্ত।বরং ছন্দকে ছুঁয়েই লিখতে হবে কবিতা।
ছড়ার ছন্দ স্বরবৃত্ত চলে চার মাত্রার ছোট ছোট চালে।ঘোড়ার মত টগবগিয়ে ছুটতে থাকে এই ছন্দ। শ্বাসাঘাত প্রধান এই ছন্দ নৃত্যচপল ছন্দস্পন্দনে স্পন্দিত।এই কবিতার দলে স্বরবর্ণের বিশেষ করে ই বা এ কারের প্রাধান্য দেখা যায়।
যেমন:-
'টগবগিয়ে /টগবগিয়ে /ছন্দ চলে /ছুটে'... এমনি একটা লাইন লেখা যেতে পারে।এখানে দেখা যাচ্ছে ৪/৪/৪/২ মাত্রার লাইনটা।কিভাবে?টগ, ব, গি, য়ে এই হল চারটি দল।স্বরবৃত্ত ছন্দে যত দল, তত মাত্রা।তাই টগবগিয়ে চার মাত্রা পাবে।
এবারে আমাদের দ্বিতীয় লাইন লিখতে হবে।আমরা লিখতে পারি, টগবগানো/ শব্দে খোকার /ঘুমটা গেল /টুটে।
এটাও ৪/৪/৪/২ এ আছে।
টগ্+ব+গা+নো = ১+১+১+১= ৪ মাত্রা।
শব্ +দে+ খো+ কার= ১+১+১+১= ৪ মাত্রা
ঘুম+টা+ গে+ল=১+১+১+১=৪মাত্রা
টু+টে = ১+১= ২ মাত্রা।
তাহলে কবিতাটা ঠিকঠাক এগোচ্ছে।এভাবে লাইনের পরে লাইন জুড়ে আমরা সঠিক স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখে যেতে পারব।এই ছন্দ ৪/৪/৪/২ বা ৪/৪/৪/১ এ ভাল লেখা যায়।৪/৪ এও লেখা যায়,তবে তাতে ছন্দের দ্রুততা আরো বেড়ে যায়।যেমন, পালকি চলে/ দুলকি চালে/ সাতবেহারা/ জোয়ান তারা। ৪/৪/৪/৪ এখানে লাইনগুলো একটা আর একটার ঘাড়ে এসে পড়ছে। কিন্তু শেষে ওই ১/২ এর ভাঙ্গা মাত্রাটি থাকলে লয়ের দ্রুততা একটু কমে।কবিতাটি সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।
স্বরবৃত্ত এমনিতেই দ্রুত লয়ের ছন্দ।টগবগ টগবগ করতে করতে চলে।সাধারণত ছড়ার ছন্দ হলেও সিরিয়াস কবিতাও লেখা যায় এই ছন্দে।তবে গুরুগম্ভীর কবিতার ছন্দ হল অক্ষরবৃত্ত,স্বরবৃত্ত নয়।
এবারে আরও একটা কবিতা দেখা যাক এই ছন্দে।
তোমরা যাবে নাইট ক্লাবে পরবে ফাটা জিন্স,
আমার ছেলে রিক্সা-পুলার, তোমার ছেলে প্রিন্স।
তোমরা হলে ধূর্ত শেয়াল, আমরা হলাম ফেউ
তোমরা যাবে ডিপ-সী-ট্যুরে, আমরা গুনি ঢেউ।
তোমরা কর পেপার-ওয়ার্ক, আমরা করি কাজ,
পুড়ছি রোদে, ভিজছি জলে, পড়ছে মাথায় বাজ।
তোমরা চাপ এ. সি. গাড়ি, আমরা ধরি ট্রেন
আসতে যেতে চেপ্টে-চিড়ে, হস্তে হেরিকেন ।
তোমারা হলে রাঘব-বোয়াল, তোমরা বানাও জোট
আমরা মশাই খেটেই মরি দিই তোমাদের ভোট ।
তোমরা পর হিরের চুড়ি, আমরা বানাই ঘট
বাড়ছে তোমার টাকার পাহাড় আমরা তো হ্যাভ-নট।
এবারে বোঝাই যাচ্ছে কবিতাটা ৪/৪/৪/১ মাত্রায় লেখা স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা।কারণ, লয় দ্রুত।জীবনানন্দ দাসের 'আবার আসিব ফিরে'র মত মন্থর তান নেই এতে।বরং ছটফটান ভাব আছে।এটাই স্বরবৃত্ত চেনার উপায়।আর তার পরেই ওই ৪/৪/৪/১ বা ২ দল কে খুঁজতে হবে।পেয়ে গেলেই বাজিমাত। কনফার্ম স্বরবৃত্ত। মাত্রা গোনা খুব সহজ এই ছন্দে।যত দল, তত মাত্রা।একমাত্র ব্যতিক্রম তিনটি রুদ্ধদল পাশাপাশি থাকলে তখন চার মাত্রা ধরা হয়।
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
তোমরা যাবে /নাইট ক্লাবে/ পরবে ফাটা /জিন্স,৪/৪/৪/১
আমার ছেলে /রিক্সাপুলার /তোমার ছেলে /প্রিন্স।৪/৪/৪/১
তোমরা হলে /ধূর্ত শেয়াল,/ আমরা হলাম /ফেউ ৪/৪/৪/১
তোমরা যাবে /ডিপ-সী-ট্যুরে, /আমরা গুনি/ ঢেউ।৪/৪/৪/১
তোমরা কর/ পেপার-ওয়ার্ক,/ আমরা করি /কাজ,৪/৪/৪/১
পুড়ছি রোদে, /ভিজছি জলে,/ পড়ছে মাথায় /বাজ।৪/৪/৪/১
তোমরা চাপ /এ. সি. গাড়ি,/ আমরা ধরি /ট্রেন ৪/৪/৪/১
আসতে যেতে /চেপ্টে-চিড়ে, /হস্তে হেরি/কেন ।৪/৪/৪/১
তোমারা হলে /রাঘব-বোয়াল, /তোমরা বানাও /জোট ৪/৪/৪/১
আমরা মশাই /খেটেই মরি/ দিই তোমাদের /ভোট ।৪/৪/৪/১
তোমরা পর/ হিরের চুড়ি/ আমরা বানাই/ ঘট ৪/৪/৪/১
বাড়ছে তোমার/ টাকার পাহাড় /আমরা তো হ্যাভ-/নট।৪/৪/৪/১
সব ক্ষেত্রেই কিন্তু যতগুলো সিলেবেল বা দল আছে তত মাত্রা হয়েছে।দল বা সিলেবেল হল এই ছন্দের প্রাণ।আরও একটু ভেঙ্গে দেখাচ্ছি :-
আসতে যেতে /চেপ্টে-চিড়ে, /হস্তে হেরি/কেন ৪/৪/৪/১
আস+ তে+ যে+তে = ৪ মাত্রা
চেপ+টে + চি+ড়ে= ৪ মাত্রা
হস+তে+ হে + রি= ৪ মাত্রা
কেন্=১ মাত্রা।
এভাবে কবিতাটি পড়তে হবে।কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চলবে ছন্দপাঠ।
আর একটি কবিতা দেখা যাক।
যখন বৃষ্টি নামলো, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা।
হয়তো মেঘে- বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে-- অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
বৃষ্টি নামলো /যখন আমি /উঠোন-পানে /একা ৪/৪/৪/২
দৌড়ে গিয়ে /ভেবেছিলাম /তোমার পাব /দেখা।৪/৪/৪/২
হয়তো মেঘে- /বৃষ্টিতে বা/ শিউলি গাছের /তলে ৪/৪/৪/২
আজানুকেশ/ ভিজিয়ে নিচ্ছো /আকাশ-ছেঁচা/ জলে ৪/৫/৪/২
কিন্তু তুমি /নেই বাহিরে-- /অন্তরে মেঘ /করে ৪/৪/৪/২
ভারি ব্যাপক/ বৃষ্টি আমার/ বুকের মধ্যে /ঝরে!৪/৪/৪/২
দেখা যাচ্ছে নির্ভুল স্বরবৃত্ত ছন্দে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতাটি লিখেছেন।৪/৪/৪/২ এর একটি ভারি সুন্দর কবিতা এটি।
খ্যতিমান কবিদের কবিতা ছন্দ মেনেই লেখা।সেগুলো পাঠের সময়ে আমরা এবারে ছন্দপাঠ করতে চেষ্টা করব।এভাবেই একদিন সঠিক ছন্দে কবিতা আসবে সব কবির কলমে।আর ছন্দ পাঠ একবার করতে শিখলেই বুঝতে পারা যাবে, তা কবিতা পাঠের চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক।
২.অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
বাংলা তিন ছন্দের মধ্যে অক্ষরবৃত্তের স্থান সবার উপরে।মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সেরা বাংলা কবিতাগুচ্ছ লেখা হয়েছে।
স্বরবৃত্ত যেন এক শিশু। গড়গড় করে কবিতা বলে।মাত্রাবৃত্ত যেন এক যুবক।একটু আধটু বুঝেছে।আর অক্ষরবৃত্ত হল পরিণত মানুষ।বুঝে শুনে মতামত দেয় গম্ভীর ভাবে।
অক্ষরবৃত্ত এক সর্বগ্রাসী ছন্দ।যুক্তাক্ষরকে অনায়াসে গিলে খায়।অনেক বাংলা শব্দ চার অক্ষরের।কিন্তু উচ্চারণ হয় তিন অক্ষরের মত।এদের তিন মাত্রাই দেয় অক্ষরবৃত্ত। যেমন-
চারজন, হাড়গিলে, কাতরাতে, কলকাতা, বুলবুলি উচ্চারণের সময়ে হয়ে যায় চার্জন,হার্গিলে,কাত্রাতে,কল্কা তা, বুল্বুলি। তাই এদের মূল্য তিন, চার নয় অক্ষরবৃত্তের কাছে।মাত্রাবৃত্ত কিন্তু এদের পুরো চার মাত্রার মূল্য দেয়।এটাই অক্ষরবৃত্তের সংগে মাত্রাবৃত্তের প্রধান পার্থক্য।
একই ভাবে কিছু তিন অক্ষরের শব্দ উচ্চারণ এর সময়ে গুটিয়ে দুই অক্ষরের শব্দে পরিণত হয়।তাই তাদের মূল্য দু মাত্রা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।যেমন- বাজনা, খাজনা, সজনে ইত্যাদি গুটিয়ে গিয়ে বাজ্না,খাজ্না,সজ্নে হয়ে যায়।আসলে লেখার অক্ষর নয়, উচ্চারণের কানই ছন্দের প্রধান অঙ্গ। এবং তাইই হওয়া উচিত কারণ, ভাষা যতটা না লেখার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি বলা ও শোনার জন্য।
তাই চোখ নয়, কান।কানের উপরেই নির্ভর করতে হবে ছন্দের জন্য।ছন্দ আসলে গানের মতই শোনার জিনিস।আর গান মানেই তো কান।তান আর কান না থাকলে গান কে শুনবে?
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে একটা সুরেলা তান থাকে।এই কারণেই একে তানপ্রধান ছন্দও বলা হয়।'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি... ' বা 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে' লাইনগুলোর তান লক্ষ্য করুন।
এবারে আসব অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সহজে কবিতা লেখার আলোচনাতে।কারণ আমরা ছান্দসিক হতে চাই না, কবি হতে চাই।
এই ছন্দে কবিতা লেখা খুব সহজ।কারণ মোটামুটি যত অক্ষর, তত মাত্রা।শুধু খেয়াল রাখতে হবে উচ্চারণের সময়ে অক্ষরগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে নাকি।গুটালেই মাত্রা কমবে।যুক্ত অক্ষরকে একটি অক্ষরেরই মূল্য দেয় এই ছন্দ।
তিনের পাশে তিন, দুই এর পাশে দুই এই হল মূলমন্ত্র অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখার।বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়।শুধু এটুকু মনে রেখে মনের সুখে কবিতা লিখুন এই ছন্দে।একদম সঠিক কবিতা হবে।
আসুন আমরা লিখি কিছু।
কি নিয়ে লেখা যায়? প্রেম? ভাল, ভাল।প্রেম অতি উপাদেয় উপাদান কবিতা লেখার।শুধু মাথায় রাখছি তিনের পাশে তিন আর দুই এর পাশে দুই।
ওগো নারী,
তোমার সাজানো ঘরে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে পারি?
পেতে পারি পিপাসার জল?
পেড়িয়ে এসেছি মরুভূমি,অনেক যুদ্ধের কোলাহল।
বড় ক্লান্ত আজ
তোমার বাগানে বসে বাজাব এস্রাজ।
এবারে যা লেখা হল তার ছন্দ বিশ্লেষণ :-
ওগো /নারী,২/২
তোমার /সাজানো /ঘরে ৩/৩/২
দুদণ্ড /বিশ্রাম/ নিতে/ পারি?৩/৩/২/২
পেতে/ পারি/ পিপাসার/ জল?২/২/৪/২
পেড়িয়ে/ এসেছি/ মরুভূমি,৩/৩/৪
অনেক/ যুদ্ধের/ কোলাহল।৩/৩/৪
বড় /ক্লান্ত /আজ ২/২/২
তোমার /বাগানে /বসে ৩/৩/২
বাজাব /এস্রাজ।৩/৩
শেষ লাইনে বাজাব না লিখে যদি বাজবে লিখতাম তা হলে কি হত? বাজবে সঙ্কুচিত হয়ে হয়ে যেত 'বাজ্বে' যা দু মাত্রার।ফলে দুই এর পাশে তিন হয়ে ভুল হয়ে যেত।
'পিপাসার জল', (৪/২)না লিখে যদি লিখতাম 'তৃষ্ণার জল' (৩/২)তাহলেও ভুল হয়ে যেত।বিজোড়ে জোড় গাঁথা হয়ে যেত।যদিও অর্থ একই থাকত।শব্দচয়ন কত গুরুত্ববহন করে, সেটা এখান থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে।
মাত্রা গোনার নিয়ম যত অক্ষর, তত মাত্রা।তবে উচ্চারণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
উচ্চারণের গুরুত্ব বুঝবার জন্য একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করুন।
"কালকা মেলে টিকিট কেটে সে
কাল গিয়েছে পাহাড়ের দেশে।"
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এই দু-লাইনের কবিতা দেখুন।
কালকা মেল উচ্চারণে হচ্ছে কাল্কা মেল, আর 'কাল গিয়েছে ' যদিও দুটি আলাদা শব্দ, পাশাপাশি বসার জন্য উচ্চারিত হচ্ছে 'কাল্গিয়েছে' হিসাবে।ছান্দসিক কবি একে বলেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের অসবর্ণ বিবাহ!
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
"কালকা মেলে/ টিকিট/ কেটে সে ৪/৩/৩
কাল গিয়েছে/ পাহাড়ের/ দেশে।"৪/৪/২
কাল্কামেল ৪ মাত্রা।কাল্গিয়েছে ৪ মাত্রা।দুটি সমমাত্রিক লাইন।১০ মাত্রার।৪+৩+৩=৪+৪+২
বিজোড়ে বিজোড়, জোড়ে জোড় হিসাবে লেখা।তাই সঠিক অক্ষরবৃত্ত।
জীবনানন্দ দাসের বেশিরভাগ কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা।জীবনানন্দের কবিতা পড়ুন আর ছন্দ নিজে বিশ্লেষণ করুন।
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
জীবনানন্দের 'অদ্ভূত আঁধার এক'- কবিতাটির বিশ্লেষণ :-
অদ্ভুত আঁধার এক/৩-৩-২ এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/৪-৪-২
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি/২-২-৪-২
আজ চোখে দ্যাখে তারা;/২-২-২-২
যাদের হৃদয়ে কোনো/৩-৩-২ প্রেম নেই – প্রীতি নেই –/২-২-২-২ করুণার আলোড়ন নেই/৪-৪-২
পৃথিবী অচল আজ/৩-৩-২
তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/৩-৫-২
যাদের গভীর আস্থা/৩-৩-২ আছে আজো মানুষের প্রতি/২-২-৪-২
এখনো যাদের কাছে/৩-৩-২
স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/৪-২-২-২
মহত্ সত্য বা রীতি,/৩-৩-২
কিংবা শিল্প অথবা সাধনা / ২-২-৩-৩
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য/৪-৪-২
আজ তাদের হৃদয়/ ২-৩-৩
দেখা যাচ্ছে নির্ভুল অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা। বিজোড়ে বিজোড়, জোড়ে জোড় গাঁথা হয়েছে।সঙ্গে রয়েছে একটানা এক তানের প্রবাহ।দুই অক্ষরের শব্দের পাশে তিন অক্ষরের শব্দ বসানোর জন্য মাঝখানে এক অক্ষরের শব্দ নিয়ে আসা হয়েছে।এভাবেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে হয়।
৩.মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
রবীন্দ্রনাথের 'মানসী ' পর্বের কবিতায় মাত্রাবৃত্তের আবিষ্কার। কবির কথায়, " যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।"
এই ছন্দে যুক্ত অক্ষরকে দুটো অক্ষরের সমান ধরা হয়।তাই দুই মাত্রা পায় একটি যুক্তাক্ষর।
রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুন কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা।
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল ,
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল ।
চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায় ,
বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায় ।
স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে ,
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে ।
এখানে যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙে ভেঙে পড়তে হবে।ফাল্গুন হবে ফালগুন।এখানে চারটি অক্ষর।তাই চার মাত্রা পাবে ফাল্গুন শব্দটি।এভাবে কাঞ্চন হবে কানচন।৪ মাত্রা পাবে।পুন্ জিত আমরোমুকুল একই ভাবে আসবে।
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
ফাল্গুনে /বিকশিত-(৪/৪) কাঞ্চন /ফুল ,(৪/২)
ডালে /ডালে/ পুঞ্জিত-(২/২/৪)আম্রমুকুল ।(৬)
চঞ্চল /মৌমাছি (৪/৪)গুঞ্জরি /গায় ,(৪/২)
বেণুবনে /মর্মরে (৪/৪)দক্ষিণবায় ।(৬)
স্পন্দিত /নদীজল-(৪/৪)ঝিলিমিলি করে ,(৪/২)
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি-(৪/৪)বালুকার চরে ।(৪/২)
'স্পন্দিত' শব্দটাকে লক্ষ্য করুন।এটা ৪ মাত্রা পেয়েছে। ৫ মাত্রা পায়নি।যদিও দুটো যুক্তাক্ষর আছে।শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা এই ছন্দে এক মাত্রাই পায়।মধ্যে বা অন্তে যুক্তাক্ষর থাকলে তবেই তা দুই মাত্রা পায়।
অক্ষরবৃত্ত যেমন শব্দগুলোকে গুটিয়ে নিতে চায়,মাত্রাবৃত্ত ঠিক উল্টো ভাবে যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙে ছড়িয়ে দেয়।মাত্রাবৃত্ত দুই মাত্রা দেয় একটি যুক্তাক্ষরকে।
এসব দেখে মনে হয়,মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে লেখা উচিত মাত্ রাবৃত্ ত ছন্ দ।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গুনতে হবে যুক্তাক্ষরকে দুমাত্রা ধরে।বাকি সব অক্ষর এক মাত্রার।অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষর এক মাত্রা পায়।এটাই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সংগে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা হিসাবের ফারাক।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, 'ছন্দ' শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা পাবে।মুক্তদল এক মাত্রা, রুদ্ধদল দুই মাত্রা পায় মাত্রাবৃত্তে।ছন্দ শব্দে 'ছন্ 'হল রুদ্ধদল, ২ মাত্রা পাচ্ছে তাই।আর 'দ ' মুক্তদল, এক মাত্রা পাবে।
মাত্রাবৃত্ত হল মধ্যম লয়ের ছন্দ।স্বরবৃত্তের মত টগবগ করে ছোটে না, আবার অক্ষরবৃত্তের মত গজেন্দ্রগমন ও করে না।
যেমন, নিচের চারটি লাইন দেখুন:-
মনের মানুষ /কপালে কি কারো /থাকে?
চুপিচুপি তাকে /মনেই থাকতে /দাও,
স্বপ্নেরা শুধু/ স্বপ্ন হয়েই /থাকে
স্বপ্নটা ভুলে /বাস্তব মেনে/ নাও।
এখানে ৬/৬/২ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চাল দেখতে পাচ্ছি।স্বপ্ন, শব্দটি তিন মাত্রা পেয়েছে।প্রাথমিক যুক্তাক্ষর-' স্ব' একমাত্রা আর পরের যুক্তাক্ষর 'প্ন' দুই মাত্রা পেয়েছে।
' বাস্তব 'চার মাত্রা পেয়েছে।কারণ যুক্তাক্ষরটি মাঝখানে আছে।যুক্তাক্ষর মাঝখানে বা শেষে থাকলেই দু মাত্রা আদায় করে ছাড়বে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।শব্দের প্রথমেই যুক্তাক্ষর থাকলে একমাত্রা পাবে।
মাত্রাবৃত্ত চার রকমের হতে পারে।৪ মাত্রা, ৫ মাত্রা, ৬ মাত্রা ও ৭ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত হয়।
ফাল্গুনে/ বিকশিত/ কাঞ্চন/ ফুল -(৪/৪/৪/২) - এটা হল চার মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত।
এবারে জয় গোস্বামীর দুটি লাইন দেখুন:-
"বেনীমাধব বেনীমাধব তোমার বাড়ি যাব- বেনীমাধব,তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?"
বিশ্লেষণ :-
বেনীমাধব /বেনীমাধব/ তোমার বাড়ি/ যাব-(৫/৫/৫/২)- বেনীমাধব/ তুমি কি আর /আমার কথা /ভাবো?(৫/৫/৫/২)
এটা হল পাঁচ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত।
এটাকে আমরা ৫/৭ হিসাবেও ভাবতে পারি, শেষ দু মাত্রাকে এক সংগে ধরে।
এবারে ৬ মাত্রার চাল দেখুন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে:-
জীবনানন্দ কবিতার কারিগর
এই বাংলায় ধানসিড়িটির তীরে
হয়তো বা হাঁস নয়তো অন্য রূপে
বাংলার কবি ঠিক আসবেন ফিরে।
বিশ্লেষণ :-
জীবনানন্দ /কবিতার কারি/গর(৬/৬/২)
এই বাংলায়/ ধানসিড়িটির /তীরে(৬/৬/২)
হয়তো বা হাঁস /নয়তো অন্য /রূপে(৬/৬/২)
বাংলার কবি /ঠিক আসবেন /ফিরে। (৬/৬/২)
৬ মাত্রার চাল, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। এটাকেও ৬/৮ হিসাবে বলা যায় শেষ দু মাত্রকে এক সংগে ধরে।
এবারে ৭ মাত্রার চাল:-
সেটা স্পষ্ট ভাবে খোদাই হয়ে আছে
সেটা মরতে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠে
তাকে মারব বলে মিথ্যে ছোটাছুটি
সেটা রোজ সকালে পদ্ম হয়ে ফোটে।
বিশ্লেষণ :-
সেটা স্পষ্ট ভাবে /খোদাই হয়ে আছে/(৭/৭)
সেটা মরতে গিয়ে/ আবার বেঁচে ওঠে(৭/৭)
তাকে মারব বলে /মিথ্যে ছোটাছুটি(৭/৭)
সেটা রোজ সকালে /পদ্ম হয়ে ফোটে।(৭/৭)
এটা হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৭ মাত্রার চাল।
এমন ৭ মাত্রার চালে আরও চার লাইন লেখা যাক।
সেটা হারিয়ে গেলে/ দারুণ ভাল হত
সেটা অনেক বেশি /কষ্ট বয়ে আনে
সেটা দিনের শেষে/ নিদ্রা কেড়ে নেয়
সেটা কাঁটার মত/ বিঁধেই থাকে প্রাণে।
৭/৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত।
এবারে আরও একটা কবিতা দেখুন।
পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে
অনেক না বলা কথা আছে নীলখামে।
ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী
শুনবে নদীর গান, কান পাতো যদি।
ও নদী কোথায় যাও? ছলছল তানে?
দাও নদী দাও বলে, জীবনের মানে।
ঘন্টার ঠুনঠুন, আজানের সুর;
নদী জলে মিশে যায় সোনারোদ্দুর।
বিশ্লেষণ :-
পাহাড়ের বুক চিরে/ ঝর্ণাটা নামে(৮/৬)
অনেক না বলা কথা/ আছে নীলখামে।(৮/৬)
ঝর্ণারা মিলেমিশে/ হয়ে যায় নদী(৮/৬)
শুনবে নদীর গান, /কান পাতো যদি।(৮/৬)
ও নদী কোথায় যাও?/ ছলছল তানে?(৮/৬)
দাও নদী দাও বলে,/ জীবনের মানে।(৮/৬)
ঘন্টার ঠুনঠুন, /আজানের সুর;(৮/৬)
নদী জলে মিশে যায়/ সোনারোদ্দুর।(৮/৬)
এটা হল ৮/৬ এর মাত্রাবৃত্ত। কিন্তু ৮ মাত্রা কে আমরা দুটি ৪ মাত্রার যোগফল হিসেবে ভাবতে পারি।তাই ৮ মাত্রার চালকে ৪ মাত্রার দুটি চালের সমন্বয় হিসাবে ধরা হয়।উপরের 'ফাল্গুনে বিকশিত/ কাঞ্চন ফুল' এই লাইনটাকেও ৮/৬ হিসাবে বলা যেতে পারত।যেহেতু ৮ মাত্রা দুটি ৪ মাত্রার সমন্বয়, তাই এই ধরনের কবিতাকে চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত হিসাবেই ধরা হয়।চোখে দেখে ' ঘন্টার ঠুনঠুন ' এই পর্বটিকে 'আজানের সুর' এর চেয়ে ছোট মনে হচ্ছে।কিন্তু 'ঘন্টার ঠুনঠুন' ৮ মাত্রার পর্ব।'আজানের সুর' ৬ মাত্রার। এজন্য মাত্রা বিচার খুব জরুরি। একই শব্দ তিন ছন্দে তিন রকম মাত্রার হতে পারে।এবিষয়ে খুব মনোযোগ দেওয়া দরকার।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখার সময় মনে রাখতে হবে এটা মধ্যম লয়ের ছন্দ।যুক্তাক্ষরগুলোকে দুটো আলাদা অক্ষর হিসাবে ধরতে হবে। যুক্তাক্ষরটি শব্দের প্রথমেই থাকলে কিন্তু এক মাত্রা পাবে।এটা মনে রাখা চাই।যেমন:-শ্মশান, স্তবক, শ্বশুর তিন মাত্রা পাবে।চার মাত্রা নয়।কারণ, যুক্তাক্ষর থাকলেও সেটা শব্দের শুরুতেই আছে।মাঝখানে বা শেষে যুক্তাক্ষর থাকলে কিন্তু দু-মাত্রা আদায় করবে এই ছন্দে।এটুকু মনে রেখে ৪/৫/৬/৭ মাত্রার চালে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখলে ভুল হবার কথা নয়।
সুকুমার রায়ের ৪ মাত্রার একটা মজার মাত্রাবৃত্তের কবিতা দিয়ে আলোচনা শেষ করছি।
সব যেন /বিচ্ছিরি /সব যেন /খালি
গিন্নীর /মুখ যেন /চিমনীর/ কালি।
মন ভাঙা /দুখ মোর /কন্ঠেতে /পুরে
আয় ভাই /গান গাই/ প্রাণফাটা/ সুরে।
মহিলা কবিদের কি হবে জানি না,কিন্তু বেশি কবিতা লিখলে বিবাহিত পুরুষ কবিদের গিন্নীর মুখে চিমনীর কালি দেখা যাবেই।তবু বুকে সাহস রেখে প্রাণভরে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখুন...
৪.মাত্রা ও ছন্দ নির্ণয়
বিখ্যাত ইংরেজ কবি কোলরিজ গদ্য আর পদ্যের কার্যকর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর বিবেচনায় গদ্য বা Prose হচ্ছে ‘Words in the best order’ অর্থাৎ শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই গদ্য। আর কবিতা বা Poetry হচ্ছে ‘Best words in the best order’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই কবিতা। এর মাধ্যমে কবিতা বা গদ্য কি তা বোঝা কঠিন। কিন্তু গদ্য বা কবিতা কিভাবে লিখতে হবে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
কবিতার ক্লাসের আগের আলোচনাগুলোতে বাংলা কবিতার তিন ছন্দ নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি।আজকে আলোচনা করব কিভাবে ছন্দের নিয়ম মেনে কবিতা লেখা যায়।
ফুলের সংগে ফুল গেঁথে যেমন মালা তৈরি হয়, ঠিক তেমন ভাবে শব্দে শব্দ গেঁথে কবিতা লেখা হয়।ভাল মালা গাঁথতে গেলে কোন ফুলটা কোন ফুলের পাশে ভাল মানাবে সেটার ধারণা থাকা দরকার। যে কোনও ফুল ইচ্ছেমত গাঁথলেই তা সুন্দর মালা হবে না কখনও।কবিতার ক্ষেত্রেও এটাই সত্য।শব্দ চিনতে হবে।শব্দের ওজন বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার করে নিতে হবে কবিতা লেখার আগেই।একই শব্দ বিভিন্ন ভাবে সাজালে তার ওজনের বিভিন্নতা দেখা দেয়।
ছন্দ শাস্ত্রে এই ব্যাপারটা মাত্রা দিয়ে মাপা হয়।
আগেই বলেছি স্বরবৃত্ত ছন্দে যত দল ( সিলেবেল) তত মাত্রা।কোনটা রুদ্ধ দল আর কোনটা মুক্তদল এসব কিচ্ছু দেখার দরকার নেই স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখার সময়ে।
তাই যেকোনো শব্দে যতগুলো দল, ঠিক তত মাত্রা হবে এই ছন্দে।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, "কোন দেশেতে / তরুলতা " এই বাক্যে কোন+ দে+শে+তে/ ত+রু+ল+তা,৪+৪ মোট আটটি দল বা সিলেবল আছে।তাই এটা আট মাত্রিক একটা বাকাংশ।
সব ছন্দেই মুক্তদল একমাত্রা।রুদ্ধদল স্বরবৃত্তে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে দুই মাত্রা আর অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এক বা দুই মাত্রা পায়।
রুদ্ধদল একা থাকলে বা শব্দের শেষে থাকলে দুই মাত্রা পায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।শব্দের শুরুতে বা মাঝে রুদ্ধদল এক মাত্রা পায় অক্ষরবৃত্তে।
যেমন, "অক্ষর " শব্দটাতে অক+খর মোট দুটি দল আছে।প্রথম রুদ্ধদলটি যেহেতু শব্দের প্রথমে আছে, তাই এক মাত্রাই পাবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।আর শেষেরটি দুই মাত্রা পাবে। তাই শব্দটা তিন (১+২)মাত্রা পাবে এই ছন্দে।
কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এটা চারমাত্রা পাবে।কারণ, দুটি রুদ্ধদল প্রত্যেকেই দুই মাত্রা পাবে মাত্রাবৃত্তে।
এবারে একটা মজা দেখা যাক।আসলে আমরা কবি হতে চাই।ছান্দসিক নই।তাই শুধুমাত্র চোখে দেখেই সহজে এই মাত্রা নির্ণয় করতে পারলে খুব ভাল হয় আমাদের জন্য।
এই জন্য নিয়ম হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যত অক্ষর তত মাত্রা।আর মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষর দুই মাত্রা। তাহলে শুধু চোখে দেখেই এবারে আসুন মাত্রা গুনে নিই।
'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল' এর মাত্রা নির্ণয় করব আমরা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৩+৪+৩+২ =১২মাত্রা পাবে লাইনটি।কারণ, ফাল্গুনে তিন অক্ষর, বিকশিত ৪ অক্ষর, কাঞ্চন তিন অক্ষর, আর ফুল দুই অক্ষরের শব্দ।
কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যেহেতু যুক্তাক্ষর দুই মাত্রা পাবে তাই ফাল্গুনে হবে চার মাত্রার।কাঞ্চন ও চার মাত্রা পাবে এখানে।লাইনটি ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে।
দল হিসাবে পরিমাপ করেও একই রেজাল্ট পাওয়া যাবে।সুতরাং কবিতা লেখার সময়ে শুধুমাত্র শব্দটার দিকে একবার তাকালেই আমরা তার মাত্রা বের করে নিতে পারব এই ভাবে।রুদ্ধদল মুক্তদলের ঝামেলাতে না গিয়েও খুব সহজেই।
এবারে কবিতা লেখার পালা।তবে কবিতা লেখার আগে আমি অনুরোধ করব কবিতা পড়ে, কোন কবিতা কোন ছন্দে সেটা খুঁজে বের করার খেলাটা খেলতে।যতদিন না এটা করতে পারা যাচ্ছে ততদিন কবিতা লেখা সম্ভব নয় ছন্দ মেনে।
এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে বুঝব কোন কবিতা কোন ছন্দে লেখা?
এটা খুবই সহজ কাজ।যেকোনও কবিতার প্রথম দুই লাইন পড়লেই এটা ধরতে পারা উচিত। লয় টা কেমন? দ্রুত, না ধীর? ধীর হলে অক্ষরবৃত্ত হবে।আর দ্রুত হলে স্বরবৃত্ত। মাত্রাবৃত্ত মাঝারি লয়ের।
কয়েকটি কবিতার লাইন মনে রাখুন শুধু।
১ . আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।
বা,
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা
...- অক্ষরবৃত্ত।
২.ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল
বা, শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভূঁই, আর সবই গেছে ঋণে।.... মাত্রাবৃত্ত।
৩. বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই.....স্বরবৃত্ত ছন্দ।
এবারে তুলনা করুন যে কবিতার ছন্দ ধরতে চাইছেন তার সঙ্গে। যেটার সঙ্গে মিলবে সেই ছন্দ হবে।
এর সঙ্গে জেনে নিতে হবে কিছু কায়দা।যেমন বিজোড়ে বিজোড়, জোড়ে জোড় শব্দ দেখলে বুঝতে হবে অক্ষরবৃত্ত। যদি দেখা যায় দুটি তিন অক্ষরের শব্দ পাশাপাশি বসেছে একটিতে যুক্তাক্ষর আছে আর একটিতে নেই তাহলে বুঝতে হবে কনফার্ম অক্ষরবৃত্ত। কারণ মাত্রাবৃত্ত হলে যুক্তাক্ষর যুক্ত শব্দটি চার মাত্রার হয়ে যেত।একই ভাবে দুটি দু অক্ষরের শব্দ পাশাপাশি বসলেও একটিতে যুক্তাক্ষর থাকলে অক্ষরবৃত্ত হবে। যুক্তাক্ষরটিই আপনাকে বলে দেবে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত না অক্ষরবৃত্ত। যুক্তাক্ষর দু মাত্রা পেলেই মাত্রাবৃত্ত।নইলে অক্ষরবৃত্ত।
যেমন উপরের উদাহরণে ' অদ্ভুত আঁধার এক' শুধু এই বাকাংশটুকুই ছন্দ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট। 'অদ্ভুত' শব্দটিতে যেহেতু যুক্তাক্ষর আছে, আর 'আঁধার' শব্দে নেই তাই এটা মাত্রাবৃত্ত হতে পারে না।অক্ষরবৃত্তের কবিতার পর্ব বিজোড় হয় না কখনো। ওদিকে মাত্রাবৃত্ত পাঁচ মাত্রায় সবচেয়ে ভাল চলে।
চার মাত্রা চারমাত্রার তাড়াতাড়ি চাল মানেই স্বরবৃত্ত।উচ্চারণের প্রথমেই শ্বাসাঘাত আসলে বুঝতে হবে স্বরবৃত্ত। যেমন 'বাঁশ বাগানে' বলতে গেলেই 'বাঁ' এর উপরে জোর পড়ছে। স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতি চারমাত্রার প্রথম মাত্রার উপর জোর পড়ে।
আগেই বলেছি ছন্দ শিক্ষার জন্য ছন্দে লেখা কবিতার বিশ্লেষণ জরুরী।কবিতা পাঠের সঙ্গে আমরা করব ছন্দ পাঠ।
"আমি যত গ্রাম দেখি মনে হয়
মায়ের শৈশব
আমি যত গ্রামে যত মুক্তক পাহাড়শ্রেণি দেখি
মনে হয় প্রিয়ার শৈশব
পাহাড়ের হৃদয়ে যত নীলচে সবুজ ঝরনা দেখি
মনে হয়
দেশ গাঁয়ে ছিল কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ
ঝরনার পরেই নদী,
নদীর শিয়রে
বাঁশের সাঁকোর অভিমান
যেই দেখি, মনে পড়ে, নোয়াখালি, শীর্ণ সেতু
আর সে না-ছোড় ভগবান।"
কবি আলোকরঞ্জনের কবিতাটি দেখুন।অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা।
তিনের পাশে তিন মাত্রার শব্দ আর দুয়ের পাশে দুই মাত্রার শব্দ।কী অসাধারণভাবে লিখেছেন কবি।আমরা শিখে নিই।
" নীলচে সবুজ ঝরনা দেখি"
লাইনটা যথেষ্ট অক্ষরবৃত্ত ছন্দের শিক্ষার জন্য।
ঝরনা উচ্চারণে ঝর্ণা , তাই দুই মাত্রার শব্দ।
'নীলচে' উচ্চারণে গুটিয়ে গিয়ে হয়ে যেতে পারে 'নীল্চে', তাই দু মাত্রার শব্দ।আবার 'সবুজ' চোখে দেখে তিন মাত্রার মনে হচ্ছে। স+ বুজ দুটি দলের শব্দ।'বুজ' দুই মাত্রার রুদ্ধদল।তাই এটা তিন মাত্রাই পাবে।তাহলে?
আসলে কবি এখানে 'নীলচে' শব্দটাকে তিনমাত্রা হিসাবে ধরেছেন।এটা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটা বিশেষত্ব। এই ধরনের শব্দকে তিন বা দুই মাত্রার,দুরকম ভাবেই ধরা যায় এই ছন্দে।এই ছাড়টা মেলে এ ছন্দে।তবে অবশ্যই উচ্চারণ শেষ কথা বলবে।
এরকম আর একটা শব্দ 'কলকাতা'। এটা তিন বা চারমাত্রা দুরকম ভাবেই লেখা যায় এই ছন্দে।যেখানে উচ্চারণে গুটিয়ে 'কল্কাতা' হয়ে যায়, সেখানে তিন মাত্রাই পায় শব্দটি।
"উচ্চারণ ভেদে হয় মাত্রাভেদ ভ্রাতা
নাহলে কলকাতা কেন হবে কলকাতা?"
এখানে প্রথম কলকাতা টি ৩ - মাত্রার শব্দ।পরেরটি চার মাত্রার।
তবে "পাহাড়ের হৃদয়ে" না লিখে "পাহাড়ের বুকে " লিখলে ছন্দের দিক থেকে বেশি সুন্দর হত কবিতাটি।কারণ, 'পাহাড়ের' শব্দটি চার মাত্রা পাবেই।আর 'হৃদয়ে' তিন মাত্রাই পাবে এই ছন্দে।
আমি যত গ্রাম দেখি/২-২-২-২
মনে হয় /২-২
মায়ের শৈশব/৩-৩
আমি যত গ্রামে যত/২-২-২-২
মুক্তক পাহাড়শ্রেণি দেখি/৩-৩-২-২
মনে হয় প্রিয়ার শৈশব/২-২-৩-৩
পাহাড়ের হৃদয়ে যত/৪-৩-২
নীলচে সবুজ ঝরনা দেখি/৩-৩-২-২
মনে হয়/২-২
দেশ গাঁয়ে ছিল কিন্তু/২-২-২-২
ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ/২-২-৩-৩
ঝরনার পরেই নদী,/৩-৩-২
নদীর শিয়রে
বাঁশের সাঁকোর অভিমান/৩-৩-৩-৩-৪
যেই দেখি, মনে পড়ে,/২-২-২-২
নোয়াখালি, শীর্ণ সেতু/৪-২-২
আর সে না-ছোড় ভগবান।/৩-৩-৪
শেষ লাইনটা দেখুন।কী দক্ষতায় লিখেছেন কবি!সত্যিই আসাধারণ কবিতাটি।কী কাব্যিক, আর কী ছন্দময়!
ডাক্তারি শেখার জন্য যেমন মানুষের শরীর কাটা-ছেঁড়া করতে হয়, সেভাবেই কবিতার কাটা-ছেঁড়াও খুব দরকার কবিতা লেখার জন্য।
আর একটা কবিতা দেখা যাক।
"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে জ্যোৎস্না করি পান
আধেকলীন অতীতে ওড়ে চন্দ্রযান।
অনিকেত পথে-পথে, গভীর প্রদেশে;
হঠাৎ দাঁড়াচ্ছ তুমি এক চিলতে হেসে।
তুলে আনছি পান্না-হীরে-মুক্তো কিছু কিছু
ইতিহাস জাপটে ধরে, ছাড়ে না তো পিছু।
ভূতকাল ভবিষ্যৎ পাশাপাশি হাঁটে
স্বপ্নবৎ বর্তমান সময়টা কাটে।
দুঃখ-সুখের লব্ধিতে, চক্রব্যূহ পথে
যুযুধান লড়ে চলি অসম দ্বৈরথে।"
কবিতাটি কোন ছন্দের? কী করে বুঝবো?
প্রথম লাইনটি দেখুন।
"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে জ্যোৎস্না করি পান"
প্রথম দুটি তিন অক্ষরের শব্দ।একটিতে যুক্তাক্ষর আছে, আর একটিতে নেই।এটাই বলে দিচ্ছে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের।পড়তে গিয়ে আমরা, 'প্রপঞ্চে চকোর-রূপে' এর পরে একটু থেমে যাচ্ছি।যদিও কোনও কমা দেওয়া নেই।
এটাকে বলা হয় কবিতার 'যতি'। আমরা পড়ছি, "প্রপঞ্চে চকোর-রূপে, /জ্যোৎস্না করি পান" মাত্রা বিশ্লেষণ করলে, ৩-৩-২/২-২-২
জ্যোৎস্না শব্দটি দুই মাত্রার।যদিও দেখে তিন মাত্রার মনে হচ্ছে।আসলে,উচ্চারণে গুটিয়ে এটা জ্যোস্না হয়ে যাচ্ছে।
"এক চিলতে হেসে" তে 'চিলতে' দুই মাত্রা পাচ্ছে।তিন নয়।কারণ? সেই উচ্চারণ। 'চিল্তে' হয়ে যাচ্ছে শব্দটা।একই ঘটনা "তুলে আনছি" এর 'আনছি' তে।এটা 'আন্ছি'।
তাই বলে কি ' আনছি' তিন মাত্রা পেতে পারে না অক্ষরবৃত্ত ছন্দে? উওরে বলা যায়, পারে।উচ্চারণ ডিমান্ড করলেই পারে।
'জাপটে' শব্দটাও এখানে 'জাপ্টে' হিসাবে পড়া যায়।তাই দুই মাত্রা পাচ্ছে।
এবারে ছন্দ বিশ্লেষণ করা যাক।
"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে /জ্যোৎস্না করি পান
৩-৩-২/২-২-২
আধেকলীন অতীতে /ওড়ে চন্দ্রযান।
৫-৩/২-৪
অনিকেত পথে-পথে, /গভীর প্রদেশে;
৪-২-২/৩-৩
হঠাৎ দাঁড়াচ্ছ তুমি/ এক চিলতে হেসে।
৩-৩-২/২-২-২
তুলে আনছি পান্না-হীরে-/মুক্তো কিছু কিছু
২-২-২-২/২-২-২
ইতিহাস জাপটে ধরে, /ছাড়ে না তো পিছু।
৪-২-২/২-১-১-২
ভূতকাল ভবিষ্যৎ /পাশাপাশি হাঁটে
৪-৪/৪-২
স্বপ্নবৎ বর্তমান/ সময়টা কাটে।
৪-৪/৪-২
দুঃখ-সুখের লব্ধিতে, /চক্রব্যূহ পথে
২-৩-৩/৪-২
যুযুধান লড়ে চলি /অসম দ্বৈরথে।"
৪-২-২/৩-৩
দেখা যাচ্ছে ৮/৬ অক্ষরবৃত্তে আছে কবিতাটি।
আধেকলীন শব্দটিকে অক্ষরবৃত্ত 'আধেক্লীন' হিসাবে চার মাত্রার শব্দে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।এখানে এটি ৫- মাত্রা হিসাবে ধরা হয়েছে।
কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এই সব মারপ্যাঁচ। আর সেটাকে ধরতে পারা কবিতা পাঠে আলাদা মজা এনে দেয়।
আরও একটা কবিতার উপরে ছুরি চালানো যাক।
"বৃষ্টি এলে শিউলিতলায়, ছাতিমগাছের ডালে
মনটা বড় কেমন করে বৃষ্টি-ঝরা কালে।
এখন তুমি অনেকদূরে না জানি কোনখানে,
ভিজছো কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলেছো গানে।
তোমার গানের সেই সুরটাই বৃষ্টি হয়ে এসে
টাপুরটুপুর পড়ছে ঝরে মেঘকে ভালবেসে।
মেঘ বিরহী,কান্নাটা তার বৃষ্টি হয়ে ঝরে
তোমার বুঝি মেঘ দেখলেই আমায় মনে পড়ে?"
এটা কোন ছন্দ?
দেখাই যাচ্ছে সুরটা আগের চেয়ে নরম।পড়াও যাচ্ছে অনেক দ্রুত।শ্বাসাঘাত আছে প্রতি প্রথম মাত্রায়।তাহলে এটা স্বরবৃত্ত।
বিশ্লেষণ করা যাক।
বৃষ্টি এলে /শিউলিতলায়, /ছাতিমগাছের /ডালে
মনটা বড় /কেমন করে /বৃষ্টি-ঝরা /কালে।
এখন তুমি /অনেকদূরে/ না জানি কোন/খানে,
ভিজছো কিংবা/ গুনগুনিয়ে/ সুর তুলেছো /গানে।
তোমার গানের/ সেই সুরটাই /বৃষ্টি হয়ে /এসে
টাপুরটুপুর /পড়ছে ঝরে /মেঘকে ভাল/বেসে।
মেঘ বিরহী,/কান্নাটা তার /বৃষ্টি হয়ে /ঝরে
তোমার বুঝি /মেঘ দেখলেই /আমায় মনে /পড়ে?
এটা ৪/৪/৪/২ মাত্রার স্বরবৃত্ত।এখানে মুক্তদল, রুদ্ধদল সাবাই সামান মাত্রা পেয়েছে।সব দল ১ মাত্রা।তিনটি রুদ্ধদল পাশাপাশি থাকলে কিন্তু চারমাত্রা পায় এই ছন্দে।যেমন, 'সেই সুরটাই' বা 'মেঘ দেখলেই', এখানে দল তিনটি কিন্তু মাত্রা চার।'সেই', 'লেই' ইত্যাদি দলের শেষে স্বরবর্ণ আছে।কিন্তু এরা রুদ্ধ দল।কারণ,এখানে 'এ-ই', দুটি স্বরবর্ণ পাশাপাশি আছে এবং একক প্রচেষ্টায় উচ্চারিত হচ্ছে।এটা হল যৌগিক স্বর।যৌগিক স্বরকে রুদ্ধদল ধরা হয়।
এভাবে যত বেশি কবিতা কাটা-ছেঁড়া করা যাবে তত ভাল কবিতার ডাক্তার বা কবি হওয়া যাবে।আধুনিক গদ্য কবিতাতে ছন্দের অনেক জটিল মারপ্যাঁচ লুকিয়ে থাকে।যেটা কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একটা রহস্য।কবিতা আসলে নারীর মত,রহস্যময়ী।কিংবা পরোটার মত।পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে কত্ত কিছু -প্রতীক, চিহ্ন, উপমা,কল্পনা, ছন্দ...
* ঋণ স্বীকার : কবিতার ক্লাস, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
No comments:
Post a Comment