শূন্যদশকের উল্লেখযোগ্য কবি নবকুমার পোদ্দার। উত্তর ২৪পরগণার অশোকনগরে বসবাসকারী এই কবিকে অনেকেই তার লেখার মধ্য দিয়ে চিনে থাকবেন। তাহলে এখন আসুন তার কবিতাযাপন ও জিরো বাউন্ডারি সম্পর্কে তার কিছু নিজস্ব বক্তব্য জেনে নিই।
আর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছে সদ্য লিখতে আসা একদম এপ্রজন্মের এক তরুন কবি প্রসেনজিৎ মন্ডল। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে এই সাক্ষাৎকার।
১/ নবকুমার পোদ্দারকে আমরা চিনি তার কবিতার মাধ্যমে। তো আমাদের তুমি বলো যে শিল্প সাহিত্যের এত বিভাগের মধ্যে কবিতাকেই কেন ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলে এবং কিভাবে এলে এই কবিতাযাপনে ?
উত্তর :- খুব ছোট থেকেই বাবার হাতে আবৃত্তি শেখার হাতে খড়ি। আমি তখন ক্লাস টুয়ে পড়ি।
"রঙ লাগাবো মনের মতন
আঁকতে যদি বলো
ওই দেখ না লাল টুকটুক
আপেল কেমন হল
এবার হবে মজা
যদি ছুরি একটা পাই
কচকচিয়ে আপেল কেটে
সবাই মিলে খাই (শৈল চক্রবর্তী)
স্মৃতি থেকে বললাম। তারপর একটু বড় হয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চ সঞ্চালনা করতাম। বেশিরভাগটাই পাড়ার ক্লাবে। নিজে স্ক্রিপ্টও লিখতাম। সাথে নাচ করতাম। এই ধরো তখন ক্লাস নাইন, টেন এ পড়ি। কলেজে পড়বার সময় শ্রদ্ধেয়া আবৃত্তিকার ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কাব্যায়ন সংস্থায় ভর্তি হই। যাদবপুর গড়ের মাঠে প্রতি রবিবার ক্লাস করতে যেতাম। এরপর আর এক শ্রদ্ধেয় আবৃত্তিকার পার্থ ঘোষ এর কাছেও বেশ কিছুদিন শিখি এবং শ্রীলেখাদির ডিরেকশনে (উনি ও ছাত্রী ছিলেন পার্থ ঘোষের) শিশির মঞ্চে নাটক করেছিলাম। "এক যে ছিল রাজা মশাই" ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে। আমাদের একটা ব্যান্ড ছিল।বিভিন্ন মঞ্চে আমরা ক'য়েকজন ছেলে-মেয়ে মিলে বিভিন্ন কবির কবিতা পাঠ করতাম মিউজিকের তালে। জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যান্ড টাও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থকরি সেরকম আসত না বলে।ব্যান্ডের স্রষ্টা ছিলেন। শ্রদ্ধেয় বিদুৎ মজুমদার(অশোকনগর ওঁনার বাড়ি)। পুজোর সময় বিভিন্ন দোকানের জন্য কন্ঠ দিয়ে বিজ্ঞাপন করে কিছু রোজগারও করেছিলাম। পিয়ালি মজুমদার নামে একটি মেয়ে ও আমি মিলে স্ক্রিপ্ট করতাম। এছাড়া অপ্টিমা ফিলিম সেন্টারে(ধাবা, বালিগঞ্জ।) অভিনয়ের ক্লাস করতাম নায়ক হবে বলে (হা। হা।) শ্রদ্ধেয় অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিলাল মুখার্জি এঁরা ক্লাস নিতেন। আসলে আমার ক্ষেত্রে শুরুটা হতো। শেষ টা আর হত না। এটাকে দুর্ভাগ্য বলে কিনা জানি না। এভাবেই একদিন কবিতারও জন্ম হল এবং কলেজ ম্যাগাজিনে তা ছাপা হয়েছিল।(যদিও তা কাঁচা ছিল।)
২/ নবদা, তোমার কাছ থেকে শুনেছি যে তুমি বেশ কয়েকবছর কবিতা লেখা থেকে বিরতি নিয়েছিলে। এখন আমার প্রশ্ন এটাই যে এই বিরতি বর্তমানে তোমার কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হলো?
উত্তর:- হ্যাঁ, দীর্ঘ বিরতি ছিল। প্রায় ৭ বছর! আমি একটাও কবিতা লিখিনি। তবে পড়তাম গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার বই। বিরতি নিয়েছিলাম রাগে, দুঃখে, অপমানে। যে সব পত্রিকা তখন আমার প্রিয় ছিল সেখানে আমার একটি কবিতাও ছাপা হত না। ১৪ সালে ফেসবুকে আসলাম বন্ধু তন্ময় কান্তি দাস, কৌশিক মিত্র ও আমার মিসেস একপ্রকার জোর করেই ফেসবুক ডাউনলোড করাল। প্রথমদিকটায় রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন। শাহরুখ খানের হিট সিনেমার পোস্টার। গাড়ির পেছনে মজাদার কিছু লেখা দেখলে তা ফেসবুকে বন্ধুদের ট্যাগ করতাম। এরপর ফেসবুকে মাস যত গড়াল অনেক পুরনো কবি বন্ধুদের দেখা পেলাম। তারা তখনও লেখা চালিয়ে যাচ্ছে। ওদের কবিতা ফেসবুকে পড়ছি। ওই সালের শেষ দিকে একটা কবিতা লিখে ফেসবুকে দিয়েছিলাম কবি বন্ধু প্রবীর চক্রবর্তী কমেন্ট করে বলেছিলেন- 'এতদিন পর ফিরে এসেও এভাবে কবিতা লেখা যায়'। ও সাধারণত চুপচাপ মানুষ - কিছুটা প্রচার বিমুখও। তাই ওর কথাটা আমাকে হন্ট করেছিল প্রবলভাবে। এরপর নতুন করে পথ চলা শুরু হল। নানান আড্ডায় কবিতা পড়তে যেতাম। গুনিজনদের সাধারণ পাঠকদের ভালবাসা পেতাম কবিতা পাঠ করে। শীবেনদা, তীর্থঙ্করদার উৎসাহে ১৫ সালের শেষ দিকে বই বের হল 'বৃষ্টি ও টবের কোরিওগ্রাফ'। আসলে এই যে দীর্ঘ বিরতি - সাতবছর না লেখার যন্ত্রণা আমার কবিতাকে আরও Active mode-এ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
৩/ একজন প্রতিষ্ঠিত ফিজিওথেরাপিস্ট হয়ে সারাদিন দৌড়ঝাঁপের মধ্যেও কিভাবে সময় বের করো কবিতার জন্য? এই পেশা তোমার কবিতায় কতটা প্রভাব ফেলেছে আমাদের যদি বলো।
উত্তর:- প্রথমত বলি 'প্রতিষ্ঠিত' এই শব্দটা আমার পেশার ক্ষেত্রে খাটে না। প্রতিনিয়ত এই পেশাও আমাকে নতুন করে শেখায়। ছোট থেকেই যেহেতু কবিতার প্রতি একটা টান অনুভব করতাম তাই শত দৌড়ঝাঁপের মধ্যেও কবিতা ছেড়ে থাকতে পারি না। নানান ধরণের রুগি দেখবার ফলে তাঁদের জীবনের যে সমস্যা তা আমার কলমে কবিতা লিখিয়ে নেয়। একজন ৯১ বছরের বৃদ্ধ তিঁনি শিক্ষক ছিলেন। তাঁকে ফিজিওথেরাপি করবার আগে কবিতা শোনাতে হয় নিয়ম করে! মাঝে মাঝে বিস্ময় লাগে এই বৃদ্ধ বয়সেও তিঁনি কত তরুণ। কতরকম গল্প করেন। বিভিন্ন লেখকদের জীবনী স্মৃতি থেকে উচ্চারণ করেন। আমি শুধু ধন্য হই। মুগ্ধ হই।
৪/ ইতিমধ্যে কবি ও দার্শনিক আফজল আলির 'জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট' বইটি প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং অনেকে পড়েছে বা অনেকে পড়ছে। এই যে অনেকেই জিরো বাউন্ডারিকে শূন্যতত্ত্বের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলেন তুমি তো কনসেপ্ট বইটা পড়েছ তাতে তোমার কি ধারনা হয়েছ যে এই কনসেপ্ট শূন্যতত্ত্ব থেকে কতটা আলাদা?
উত্তর:- জিরো বাউন্ডারি মানে চারপাশের বাধা বা বাউন্ডারিগুলো আসলে বাউন্ডারি নয়। বাউন্ডারি ভেঙে ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার নাম হল জিরো-বাউন্ডারি। এটা শূন্যতত্ত্ব নয় এক্কেবারে।
৫/ জিরো বাউন্ডারি গ্রুপের তুমি একজন বলিষ্ঠ এবং অন্যতম সদস্য হিসাবে তোমার কাছ থেকে জানতে চাইব যে কনসেপ্ট যে বলে শব্দের মধ্যেকার জড়তা কাটিয়ে উঠতে হবে বা শব্দের জাড্যধর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে সেটা কিরকম হতে পারে যদি তোমার মতো করে বলো।
উত্তর:- কবিতার যেহেতু নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। বা হয়ও না। কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে force apply এর কথা বলা আছে জিরোতে। জাড্যধর্ম অতিক্রম যদি করা যায় তবে সে ক্ষেত্রে কবিতা হয়ে ওঠে দীর্ঘমেয়াদি স্ফুরণ।
৬/ এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি যে দাদা তোমার বিবাহিত জীবন কতদিনের? তোমার বিবাহিত জীবনে এমন কিছু কি ঘটেছে যেটা তোমায় খুব লিখতে সাহায্য করেছে বা বৌদি কি লেখালিখির কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়?
উত্তর:- হা। হা। বিয়ে! এসব নিয়ে প্রশ্ন করো না। এই তো সেদিন বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেছিলাম তার জন্য চরমতম শাস্তি হয়েছিল। সারাদিন মুখভার। ওই যে গ্রীক মতবাদ আছে তো। "যদি তুমি ভাল স্ত্রী পাও তবে তুমি সুখি হবে । আর খারাপ পেলে দার্শনিক হবে" কিংবা "স্বামীদের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে তাঁদের স্ত্রীরা কমিক খুবই পছন্দ করে " এবার বুঝে নাও বিয়ে করবে কি না। হা। হা।
৭/ আচ্ছা তুমি নিশ্চই দেখেছ যে এই কনসেপ্ট পড়ার পর অনেকের কবিতাই চেঞ্জ হয়েছে যেমন আমি বইটা পড়ে বা আফজলদার সাহায্যে কবিতার একটা দিশা পেয়েছি যা আমার লেখা তো চেঞ্জ করতে সাহায্য করেছে অনেক সেরকম তুমি কি তোমার কবিতায় প্রয়োগ করেছ?
উত্তর:- কনসেপ্ট পড়েছি। সবটাই বুঝে ফেলেছি এমন দাবীও করি না। কনসেপ্টটায় অনেক দিক নির্দেশ করা আছে। কবিতা নিয়ে অনেকরকম অধ্যায় আছে। তা পড়লে নিশ্চয়ই কাজে লাগবে।
৮/ তোমার কাব্যগ্রন্থ "পেখমবাড়ি" প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে অনেক গুনীজনসহ সাধারণ পাঠকেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তোমার স্যাটিস্ফ্যাকশন কতটা আছে?
উত্তর:- যে কোনো শিল্পেই স্যাটিস্ফ্যাকশন এসে গেলে মুশকিল। অনেকটা শ্যাওলাধরা পুকুরের মত তার চরিত্র হবে। প্রতিটি লেখাই নতুন করে আসে। আগে কি লিখেছি তা ভুলে। ক্রমশ রোদ্দুরের কাছে আলাপ জমাতে হয়।
৯/ আর একটা প্রশ্ন যে তোমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "বৃষ্টি ও টবের কোরিওগ্রাফ" ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "পেখমবাড়ি" এই দুটোর মধ্যে তফাৎ কতটা আছে বলে তোমার নিজের মনে হয়? আর আগামীতে আমরা কি কোন নতুন কাব্যগ্রন্থ পাচ্ছি এবং তোমার আগামী কবিতাচর্চা নিয়ে তোমার পরিকল্পনার কথা আমাদের জানাও।
উত্তর:- 'বৃষ্টি ও টবের কোরিওগ্রাফ' ৩২ পেজের বই যেখানে আমি ছন্দ লিরিকের ধার ধারিনি। আবহমান বাংলা কবিতার প্রতিমা ও আবেগ থেকে সরে নিজের মত করে হেঁটেছিলাম...(শ্রদ্ধেয় কবি ও গদ্যকার বারিন ঘোষাল পাঠপ্রতিক্রিয়া) এছাড়া শ্রদ্ধেয় আফজল আলি, যশোধরা রায় চৌধুরী অংশুমান কর সহ অনেক সাধারন পাঠকেরও ভালবাসা পেয়েছিলাম বইটির জন্য। আর 'পেখমবাড়ি' সেখানে ৬৪ পেজ। অনেক গুলি কবিতা রয়েছে। এ বইটি ঘিরেও পাঠকের উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। অনেক রিভিউ পেয়েছি। (যদিও রিভিউ পড়ে বই কেমন তা বিচার করা যায় না। বড়জোর একটা ধারণা বা আগ্রহ জন্মালে জন্মাতে পারে। বাকিটা হাতে আসলে গভীর মনোনিবেশ এ বোঝা যায়।) আগামীতে নতুন কাব্যগ্রন্থ করার কথা এখনও ভাবিনি। কবিতাচর্চা নিয়ম করে হয় না। ফাঁক পেলে বরং নানান বিষয় পড়ি।
১০. ছন্দকবিতা নিয়ে জিরো বাউন্ডারি দর্শন যা বলে সে ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? তোমার কি মনে হয় যে সেইসব ছন্দকবিতার ভাষা, শব্দচয়ন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেমন হবে?
উত্তর:- ছন্দ শব্দকে চকচকে করে। অনেকে ছন্দ বলতে চরণ বা পঙতির শেষে যে ধ্বনির আবহ তা বোঝেন। আদতে ছন্দ তা নয়। তাঁকে কাব্যালঙ্কার বলা হয়। কবিতা লিখতে ছন্দ জানতেই হবে তা নয়। তাঁকে অবশ্যই কবিতা পড়তে হবে। কবিতার বৈশিষ্ট্য কী রকম সে সম্পর্কে সম্যক সাধারণ ধারণা থাকতে হবে। ছন্দ কবিতার আবেগ নিশ্চয় এখন সত্যেন্দ্র নাথ দত্তর মত হবে না। জিরো-বাউন্ডারি বলে কবিতা বহুরকম ছন্দে গদ্যে সমান তালে সে সংযুক্ত থাকে।
১১/ মানসিক শক্তি বা mental force এর সাথে জিরো বাউন্ডারি force এর কতটুকু পার্থক্য আছে বলে তুমি মনে করো?
উত্তর:- মানসিক শক্তি অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষের ভিতরকার চিন্তাভাবনা মেন্টাল ফোর্স মূলত স্ট্যাটিক। কিন্তু জিরো-বাউন্ডারি হল সেই নিখুঁত নাবিকের মত যে কিনা শত বাধা বিপত্তি সত্বেও জাহাজ বন্দরে ভিড়ায়। জিরো-বাউন্ডারি ফোর্স সচল অবস্থায় সে ফোর্স প্রতিমুহূর্তে কাজ করে।
১২/ কবিতার ক্ষেত্রে বাউন্ডারির বিলোপ কিভাবে হতে পারে তা তোমার কাছ থেকে জানতে চাই। কনসেপ্টে এই জিরো বাউন্ডারি প্রক্রিয়াটিকে never ending বলা হয়েছে কেন?
উত্তর:- বাউন্ডারি বিলোপ বা সরে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া তা ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতা, শক্তি ইচ্ছা সহায়ক এবং মেধার যথাযথ প্রয়োগ ও চেষ্টার উপর। বাউন্ডারি বিলোপের এই ধারাকে never ending। সময় কে সামনের দিকে open করা হয়েছে।
১৩/ নতুন লিখতে আসা কবিদের তুমি কিভাবে গাইড করো বা কি মেসেজ দিতে চাও? জিরো বাউন্ডারি দর্শন নতুনদের আগামীদিনে কবিতাচর্চার জন্য কতটা space বা জায়গা করে দিতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর:- খেয়েছে!! আমিই তো কত কিছু জানি না বুঝি না। আমি আবার কি পরামর্শ দেব। তবুও যে সব তরুণ, তরুণী তাদের কবিতা আমাকে দেখায় আমি আমার মত করে তাদের পথ টুকু দেখাই। কেউ কেউ সে পথ বেছে নেয়, বা নেবে, কেউ নেবে না। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাদের কে এখানে একটা গল্প বলি। যদিও গল্প ঠিক নয়। বিক্রমাদিত্যর রাজসভায় দু'জন পন্ডিত কবি ছিলেন। কালিদাস ও ভবভূতি এই পন্ডিতদের মধ্যে লড়াই চলছিল কে বড় কবি। বিক্রমাদিত্য শুকনো একটা গাছের ডাল এনে দু'জনার সামনে রাখলেন।এবং বললেন এবার বলো এটা কি। তখন ভবভূতি বলল-"শুস্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে" আর কালিদাস বলল "নীরস তরুবর পুরোত ভাগে" এই ভাষার মাধুর্য কালিদাসকে জিতিয়ে দিল অর্থাৎ কথার প্রকাশ ভঙ্গিতে। এই মাধুর্য আমাদের মনে শান্তি এনে দেয়।
১৪/ আচ্ছা নবদা, আমি জানি যে তুমি একজন কবি ছাড়াও ভালো পাঠকও। কারোর কবিতা যখন তুমি পড়ো কি নিরিখে তাকে ভাল বা মন্দ বলো আমরা জানতে চাই তোমার থেকে।
উত্তর:- প্রত্যেক কবিই কিন্তু ভেতর থেকে একজন সজাগ পাঠক। কবিতার ভাল মন্দ নিয়ে ব্যাখা দেওয়া সহজ নয়। আমার যেটা ভাল লাগে না তা হয়ত অন্যের ভাললাগে। তবুও যে কবিতা আমাকে স্তবকে স্তবকে দাঁড় করিয়ে রাখে, আমাকে অণুভবের পাঠশালায় বসিয়ে রাখে সেসব কবিতা আমার ভাল লাগে। আবার কোনো কোনো কবিতার দু'একটি পংক্তি উজ্জ্বল উদ্ধার হতেই পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে তা কতটা উত্তরণ ঘটালো সেটাই লক্ষনীয়।
১৫/ কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নিরপেক্ষতার বিষয়ে তোমার মতামত কি? বিশ্বশান্তি ও স্থিতাবস্থা স্থাপনে জিরো বাউন্ডারি দর্শনের ভূমিকা কিরকম হবে বলে তুমি মনে করো?
উত্তর:- কবি তো শিল্পী নিজে একজন রক্তমাংসের মানুষ। তার প্রেমিকা আছে প্রেমিক আছে ভাই, বোন,আত্মীয়-স্বজন, পরিজন আছে। তাকেও হাটবাজার সবই করতে হয়। তাই সে সমাজচ্যুত নয়। তাই কবির দায়িত্ব থাকবেই। কিন্তু তুমি যদি কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দাও তবে মুশকিল। একজন কবি মানুষের বোধের দরজায় আঘাত করতে পারে। দরজা খোলার দায়ভার তাকেই নিতে হয়। কবি সাংবাদিক নয়। প্রত্যেকদিনের ঘটে যাওয়ার ঘটনার সে বিশ্লেষকও নয়, তাই না? কেউ তো সার্বিক ভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না বর্তমান ব্যবস্থায় অগণিত মানুষ প্রতিযোগিতার মধ্যে সাঁতার কাটছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে সুন্দর প্রচ্ছদের মত একটা জীবন দরকার। স্থিতাবস্থান পরিবর্তনের মধ্যে তা একমাত্র বজায় রাখা সম্ভব। মাদার টেরিজাকে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিশ্বশান্তি প্রসারের উদ্দেশ্যে আপনি কিছু বলুন। তিঁনি বলেছিলেন - "বাড়ি যাও, নিজের পরিবারকে ভালবাসো"।
১৬/ এখনো পর্যন্ত দেখেছি কবি নবকুমার পোদ্দারের লেখা বেশকিছু লিটল ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এখানে আমার প্রশ্ন হল লিটল ম্যাগাজিনের সাথে বানিজ্যিক পত্রিকার কবিতার তফাৎ কিরকম দেখো?
উত্তর:- বানিজ্যিক হোক আর লিটিলম্যাগ প্রত্যেকেই সেরা লেখাটা ছাপতে চেষ্টা করে। যদিও দুটি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে। বানিজ্যিক পত্রিকাও যেমন ভাললাগে। তেমনি লিটিলম্যাগও।
১৭/ বর্তমান বহুমাধ্যম সমাজে বই পড়া থেকে মানুষ কিছুটা হলেও সরে গেছে। এছাড়া সাহিত্যের অন্য শাখার তুলনায় কবিতার পাঠক সংখ্যা এমনিতেই অনেক কম। তাই কবিতাকে মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া তথা পাঠককে কবিতামুখী করার জন্য কি কি করা যেতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর:- আসলে মানুষের হাতে অবসর সময় অতিবাহিত করবার জন্য এখন নানান মাধ্যম। আগে তো এমনটি ছিল না। এখন সিরিয়াল যুগ। আন্তর্জালে মানুষ ভাব বিনিময় করছে। আর কবিতার পাঠকসংখ্যা চিরকালই সংখ্যালঘু। ঘরে ঘরে কবিতার পাঠক কবিতার বই এমন দৃশ্য আর একটি পৃথিবীর জন্ম হলেও বোধহয় হবে না। কবিতা চিরকালই বিনোদনের চৌকাঠ পেরিয়ে নির্জনতায় বসবাস করতে ভালবাসে। আর পাঠককে কবিতামুখী করে তোলার জন্য যতটা সম্ভব সহজ সরলভাবে লেখা যেতে পারে। কিছু টাকা জমিয়ে কবিতার বই প্রতিমাসে কেনা হলে কবিতা প্রকাশকরা তখন এমনিতেই বই করবে।
১৮/ এবারে বলো তোমার প্রিয় কবি কে এবং তাঁর কবিতা কিভাবে ও কেন তোমার কাছে প্রিয় হয়েছে? কি বিশেষত্ব তুমি খুঁজে পেয়েছ তাঁর লেখায়?
উত্তর:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার, তারাপদ রায় সহ অনেক। একালের অনেক কবিই প্রিয়। কবিতা মানে শুধু পেলব মধুর বসন্ত নয় জ্ঞানবিজ্ঞান অনুভব জলবায়ু কতকিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। কবিতা ফ্রিজিড হয়ে পড়ে থাকে না। কবিতা কখনো মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয় না। প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে রসদ জোগায়।
১৯/ একটু জিবাক গ্রুপের প্রসঙ্গে আসি, তুমি তো জানোই এই আগস্টে জিরো বাউন্ডারির হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ একবছর পূর্ণ হল। তুমি এই গ্রুপে একজন সদস্য হয়ে কি বলবে যে কতটা এগিয়ে থাকে এই গ্রুপ অন্যদের থেকে বা কিভাবে এখানে কবিতাকে পরিশীলিত করা হয় বা কিভাবে এখানে কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়?
উত্তর:- একালের অন্যতম উচ্চারণের কবি আফজল আলিকে ধন্যবাদ জানাই জিরো বাউন্ডারি আরও এগিয়ে যাক। শুভেচ্ছা রইল।
I know nothing. but try to know everything.
যাঁরা আমাকে কবিতা নিয়ে এগোতে সাহায্য করেছে যেমন পার্থ সারথি দে ভৌমিক, তীর্থংকরদা, বিশ্বরুপ দে সরকার, প্রবীর চক্রবর্তী, অংশুমান কর, হিন্দোল ভট্টাচার্য, আফজল আলি, যশোধরা রায় চৌধুরী এই সমস্ত শ্রদ্ধেয় মানুষদের আমি পাশে পেয়েছি তাদের প্রণাম জানাই। এই গ্রুপের বন্ধু রুমা ঢ্যাং অধিকারী, কুমারেশ সহ সমস্ত তরুণদের ভালবাসা জানাই। এখানে খুব ভাল চর্চা হয় কবিতা নিয়ে। যা অন্য গ্রুপ থেকে আলাদা।
২০/ নবদা, তোমার ফ্যানফলোয়ারদের কাছে তোমার জন্য প্রশ্ন পাঠাতে বলা হয়েছিল সেখান থেকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি যেটা এই গ্রুপেরই একজন শান্তনু পাত্র আমাদের কাছে পাঠিয়েছিল সেটা হচ্ছে যে কবিতা তোমাকে কি দিয়েছে?
উত্তর:- মানুষের সকল অনুভূতির প্রকাশ করার উৎকৃষ্ট মাধ্যম হল কবিতা। সেই কবিতা লিখে অনেক আনন্দ পাই। অনেক গুনিজনদের সাধারণ পাঠকের ভালবাসা পেয়েছি যাঁরা আমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছেন। একসময় অনেক অপমান,দুঃখ ও পেয়েছি বা এখন ও কেউ কেউ আছেন অপমান ও শত্রুতা পাকানোর চেষ্টা করেন। মন খারাপ হয়। কিন্তু সেসব ভুলে গিয়ে নতুন করে লিখতে বসি। গুনিজন সাধারণ পাঠকদের এই ভালবাসাটুকুই তো পুরস্কার তাই না। আর কবিতা লেখার জন্যই তো এই সাক্ষাৎকার। কবিতা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। আমার জ্ঞান খুব কম। তবুও এই সাক্ষাৎকার দিলাম তোমাদের ভালবাসার জন্য।
২১/ এখন তোমার কিছু কবিতা জিরো বাউন্ডারি কবিতার পাঠকদের তুমি উপহার দাও।
উত্তর:- নিচের কবিতাগুলো দিচ্ছি -
প্রেম
সব মেঘে বৃষ্টি হয় না
তেমনি সব প্রেমেও আকাশ থাকে না!
তবু প্রেম হয়।
মানুষ মানুষে মেশে
হাতঘড়ি পালটে পালটে যায়।
অ্যাট দ্য রেট অফ প্রোফাইল পিকচার
রাতজাগা প্যাঁচার মত তোমাকে দেখে চলেছি সর্বত্র
চাঁদের আলোর সিঁড়িতে তোমাকেই তো চেয়েছি অহর্নিশ
শ্যাডো প্রাকটিস করেছি
মেঝেতে,মাঠে
চৌমাথায় প্রিন্ট করা সুবর্ণরেখার আবহে
তোমাকেই আগলে রাখতে চেয়েছি।
আমার কাননবালা মাধ্যাকর্ষণ আমার মাধুরী বাতিঝাড়
আমার নেশা ধরানো ব্যালকনি 'জুন'
যা কিছু কলাকৌশল
তোমার সিঁথিতে ভোর পৌঁছে দেব বলেই না
এতবার প্যাচপ্যাচে এই প্রোফাইল পিকচার বদলানো
রাখাল দাস কিংবা গমকল
এ জন্মে কবি হবে না জেনেও
রাখালদাস শব্দ সাজায়
ঘড়ঘড়িয়ে গমকল চলে
রাখালদাস গমকলকে
কবি মনে করে।
কবির মত উপাসনা করে।
তারপর একসময় গমকল
নিস্তেজ হয়ে চোখ বুঝে ফ্যালে।
রাখলদাস গমকল কে
চাদরে মুড়ে রেখে
আলো নিভিয়ে চলে যায়।
আর যেতে যেতে ভাবে।
আর একটা গমকল
আর একটা ঘড়-ঘড়
তার হাতের তালুর মত
বিছানা পাতবে...
আয়না
আয়নায় আন্তরিক এই দেহ
দেহে দেহে রসযাত্রা
একটা ছুরি
ভূগোল কাটতেই
পৃথিবী পাখির অভাব গোছায়
অভ্যেস
দু'হাতে কোনো ভয় নেই
তালগাছের মত লম্বা ক্লাউন
ঝোপের ঢাকনা খুলে
ছায়ামানব হয়ে নাচছে
সমগ্র লীলাক্ষেত্র সে বুকের ডানদিকে রেখে
আমাদের উৎসর্গ করছে!
এত বর্ণমালা পুরাকাল পেরিয়ে
সমুদ্র শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
যে চোখে শুধুই ডুগডুগি
তার কিবা ফণার প্রয়োজন।
নদী
সাঁতরাতে সাঁতরাতে কখন যেন তুমি নদী।
অনেক নদী দেখেছি।
তারবাহুডোরে সাঁতার ও কেটেছি।
পাঠক্রমের অভ্যাস,ধ্যানযোগ মন্ত্রসূর্য
কী অনায়াস তার উচ্চারণ
কী অনায়াস তার জ্যামিতি
সরলরেখায় বারিপাত।
আমি সাঁতার কেটে কেটে পূর্ণিমায় ফিরি।
প্রতিদিন হাতে করে
শ্যাওলা,জলজউদ্ভিদের খবর পবিত্রসঙ্গম লিখে দিই...
দুইয়ে দুইয়ে আট
রুপ মানেই ব্যানার
ব্যানার দেখে সুইং করবে সভ্যতা।
তারপর যাবতীয় পাশা খেলায়
দু'ইয়ে দু'ইয়ে আট করে
তোমাকে শুইয়ে দেবে মায়াজালে!
তোমার চিৎকার শুনেও
একালের কৃষ্ণ কৌশল বাড়িতে এঁকে আয়ু কূড়োবে
ততক্ষণে তুমি নিকষ অন্ধকারের উপসংহার গিলে ফেলেছ।
আমাদের গোল্লা ছুটল রে
ক্রমশ টেস্কট অনন্ত
বাদামের খোসার মত নির্বাক দর্শক
লবণের আদ্রতা মেপে
দিন ঘড়ির তরঙ্গে
জাহাজের পাইচারি আজকাল
আলোচ্য কোর্টেশন নয়
জিরাফের জ্যামিতি সৌখিন হলেও
তার গতিবেগ নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
আলপথ
ভোর হবার আগে কুটুম্ব দেখা যায় না।
অথচ অলিন্দ ঘিরে কলরব!
সমস্ত ডানা ঝাপটিয়ে যখন ধারাভাষ্য ফোটে
তার রূপের অণুভবে ভূমিকা মুক্ত হয়;
একদিকে স্নায়ু কেঁপে কেঁপে জলছবি
সন্তানের মত সংলগ্ন পৃথিবী
যেন এক একটি দিন।
এসব স্বীকারোক্তি
মূলতানি মাটির প্রার্থনা জুড়ে থাকে।
সরলতা
পড়ে আছে বরফের ঘর
কলরবহীন নুন।
স্বরলিপি মায়াবী
আধখানা নদী।
পড়ে থাকে সন্ধ্যা সাঁকো
চোখের সরলতা
হেঁটে যাচ্ছে...
আলপথ
ভোর হবার আগে কুটুম্ব দেখা যায় না।
অথচ অলিন্দ ঘিরে কলরব!
সমস্ত ডানা ঝাপটিয়ে যখন ধারাভাষ্য ফোটে
তার রূপের অণুভবে ভূমিকা মুক্ত হয়;
একদিকে স্নায়ু কেঁপে কেঁপে জলছবি
সন্তানের মত সংলগ্ন পৃথিবী
যেন এক একটি দিন।
এসব স্বীকারোক্তি
মূলতানি মাটির প্রার্থনা জুড়ে থাকে।
সরলতা
পড়ে আছে বরফের ঘর
কলরবহীন নুন।
স্বরলিপি মায়াবী
আধখানা নদী।
পড়ে থাকে সন্ধ্যা সাঁকো
চোখের সরলতা
হেঁটে যাচ্ছে...
দারুণ লাগলো
ReplyDelete