দিনের শুরুটা ভালো না হলে সারাটা দিন যাদের কপালে ভাঁজ পড়ে থাকে তাদের দলে আমাকে পড়তে নেই।জীবন আর মৃত্যুর ইন্টারফেস এ কাটাতে হয় বলে ধরেই নিতে হয় সকাল থেকেই যেকোনো মুহূর্তে কারুর শেষ নিশ্বাসের সাক্ষী আমাকে থাকতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে অবাক হই না ইদানিং তবে বেশ ভালই লাগে বলা বাহুল্য।অতএব সবসময়ই কিছুটা প্রস্তুত থাকতে হয়।কখন কোন পরিবারের প্রিয়জন বিয়োগের সার্টিফিকেট লিখতে হয় নিরস বদনে।
আজ সকালটা বেশ শুরু হয়েছে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট থেকে একসাথে তিনজন ছুটি পাচ্ছে এবং চার জন ওয়ার্দে শিফ্ট হচ্ছে। সাত সাতটা পরিবারের খুশির শরিক হতে পেরে বেশ ভালই লাগছে। প্রতিটা রুগীর বাড়ির পরিজনদের হাসি মুখ দেখতে আমার বেশ লাগে। যদিও এ খুশির কেউ ভাগীদার নেই। কাউকে বোঝান যায় না এ আনন্দ ধারার ছলাচ্ছল। এ নিতান্ত আমার আর আমার মতো মানুষদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।তবু কথায় আছে সুখ ক্ষণস্থায়ী। এক্সটেনশন লাইন নিঃশব্দ সকালের মৌনতা খান খান করে বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং করে
হ্যালো সি সি ইউ । হ্যাঁ...বেড খালি হচ্ছে... রেডি করতে কিছু সময় লাগবে...আমরা ফোন করে ডেকে নিচ্ছি।
ফোন রেখে সিস্টার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন গাইনি থেকে কল ছিল। একটা মা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। গতরাতে সিজার হয়েছে
এই হটাৎ করে খারাপ ব্যাপারটা খুব খারাপ সংকেত! অতএব আনন্দ যজ্ঞের জ্বলন্ত কাঠ এ কেউ যেন স্বতঃ প্রবৃত্ত হয়ে জল ঢেলে দিলো সুন্দর সকালে। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রলিতে করে সদ্য প্রসুতিকে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে চলে এলো গাইনি ওয়ার্ডের ওয়াড বয়।
প্রাথমিক পরীক্ষা করে বুঝে গেলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবুও চেষ্টা করতে হবে শেষ বারের মতো। আমার সন্তর্পনে ফেলা শ্বাসের আওয়াজে প্রসূতির স্বামী কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। ডাক্তার বাবু কি বুঝছেন? প্রশ্নের জবাবে খুব খারাপ বলে শেষ চেষ্টা করতে লেগে গেলাম। চেষ্টাই সার হলো।ফল কিছুই হলো না। জীবনের কোনো লক্ষণ পেলাম না। কোনরকম নয়।
সদ্যজাত শিশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ। কেবল তার সবথেকে প্রিয় মানুষটি তার জন্মের কিছু পরে তাকে ফেলে চলে গেছে অনেকদূর। এটি তার নবম গর্ভ। পঁচিশ বছর বয়সে নটা সন্তান। প্রতি বছর হলে বিয়ের সময় বয়স ষোলো বছর। এই ২০১৮ সালেও এমন ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সমাজ এখনও নাবালক। মেয়েরা সন্তান উৎপাদনের মেশিন ছাড়া কিছু নয়। দেখতে হয় এসব আমাদের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। কৈফিয়ত চাইতে নেই। ধর্মের দোহাই ঈশ্বরের অজুহাত পিঠ চাপড়ে চলে যাবে।
আমি তাকিয়ে আছি সেই মায়ের দিকে। কি শান্তির ঘুম। কতদিন ঠিকমতো ঘুম না হলে পরে যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে দেখেছি ঠিক সেরকম। কি মমতা জড়িয়ে আছে সারা মুখে চোখে। ক্লান্তির ঘুম। তৃপ্তির ঘুম। স্বস্তির ঘুম।
কোনো কিছুই থেমে থাকে না কারুর জন্য। প্রিয়জন লাশ হতে যেটুকু সময় লাগে ততটুকু অপেক্ষা। তারপর বাঁধানো ফ্রেম। কারুর সেটুকুও জোটে না। তবু সময় এগিয়ে যায়। নদীতে জোয়ার আসে। চাঁদ ওঠে বাঁশবাগানের মাথার ওপর। মসজিদে আজান দেয়। মন্দিরে কাঁসর বাজে।
কবি বলেছেন নদীর কোনো নাম হয় না। নাম হয় নদী খাতের। যে খাত বয়ে কখনও ঘোলা জল কখনও স্বচ্ছ কখনও জোয়ার কখনও ভাটা কখনও মাতাল কখনও শান্ত জলের খেলা। ঢেউয়ের ওঠা নামা। কখনও ক্লান্ত সূর্যের অবগাহন। হাসপাতালে এসে গেলে রোগীর নাম থাকেনা। থাকে শুধু নাম্বার। বেড নাম্বার। কখনও শ্বাস ওঠা রোগী কখনও যুবক। কখনও বৃদ্ধ। কারুর মা কারুর সন্তান । প্রিয়জন। এক থাকে বিছানা। বদলে যায় শায়িত রোগী। নদীর ঢেউয়ের মতো ওঠা নামা করে শ্বাস। নদীর মতো বেঁকে যায় জীবন গোধূলির মত। সি সি ইউ কেবিন এর এক নম্বর বিছানায় গত দুদিন একটু বেশি সময় কাটাতে হয় আমাকে। এগারো বছরের হাসি গত দুদিন হলো এসেছে।
-ডাক্তার কাকু আর কতদিন থাকতে হবে আমায়
-এই তো দু একদিন। কেনো তোর অসুবিধা হচ্ছে?
-তা নয়। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। শাবির কে বলেছিলাম এবার রোজা শেষ হলে একটা জিনিস দেবো।
-কি দিবি!আমাকে বলবি?
-ইসস। সে বলা যাবে না। আচ্ছা কাকু আমাকে আর কতদিন রক্ত দিতে হবে? আমার রক্ত কোথায় যায়?
কিছুক্ষণ চুপ ছিলাম। কি বলবো। বলা ভালো কি বলা যায়। ছোটো থেকে এতবার রক্ত নিতে হয়েছে। গতবার যখন এসেছিল তখন থেকে আমার সাথে আলাপ। আমাদের একান্ত খুনসুটি। আগেরবার ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গেছিলাম। এবার কিছু একটা বলতে হবে।শরীরটা বেশ খারাপ। রোগা হয়ে গেছে।গায়ের রং বেশ কালচে। থ্যালাসেমিয়ার মেজর। প্রায়ই রক্ত দিতে হয়। হাতের শিরা পাওয়া ইদানিং বেশ কষ্ট সাধ্য। অতএব বিশ্বাস যোগ্য একটা গল্প বলতেই হবে...
তোর শরীরে একটা রাক্ষস আছে পেটের মধ্যে। এই ঠিক এদিকটা। পেটের বামদিকে পিলের ওপর হাত রেখে বললাম।( অনেক টা বড়ো হয়ে গেছে। প্রায় নাভির কাছাকাছি চলে এসেছে।) সে বসে বসে তোর রক্তগুলো খেয়ে ফেলে। আর এই রক্তে থাকে আমাদের শরীর কে বাঁচিয়ে রাখার সেনারা। সেই রাক্ষস রক্তের সাথে সেই সব সেনাদেরকে খেয়ে নেয়। তার জন্য বাইরে থেকে বদ মতলবি আমাদের শরীরে ঢুকে যায়। খুব যুদ্ধ হয়। তখন তোর শরীরে জ্বর আসে। আমরা বুঝতে পারি এবার তোর শরীরে আরো সৈন্য পাঠাতে হবে। যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। এই রক্ত দিয়ে আমরা তোর শরীরে সৈন্য পাঠাই।তারপর সে কি যুদ্ধ। আসতে আসতে শত্রুরা মারা যায়। আর তুই সুস্থ হয় এ যাস...
যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে হাসির মুখের দিকে তাকাতে দেখি ঘুমিয়ে গেছে কখন আমার এই আষাঢ়ে গল্প শুনতে শুনতে। কি জানি বিশ্বাস করলো কিনা। জেগে থাকলে হয়তো বলতো ধুস এরম হয় নাকি। রাক্ষস যুদ্ধ ওসব গল্পে হয়।
বিনা পয়সায় রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে সরকারি হাসপাতালে। বাচ্চা নেওয়ার আগে একটা রক্ত পরীক্ষা। তাতেই জানা যেতো ওর বাবা মায়ের দেহে প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে থ্যালাসেমিয়ার জিন। তাহলেই বাচ্চা না নিলে সারা পরিবারের এই যে ভোগান্তি, এটুকু মেয়ের এই কষ্ট কিছুই হতো না। এর কোনো চিকিৎসা নেই। যতদিন বাঁচবে শুধু রক্ত দেওয়া। খুব বেশি হলে পিলেটাকে কেটে বাদ দেওয়া। তাতেও তাৎক্ষণিক। কিছুটা সময় বেশি বাঁচানো যায়। সরানো যায় না। একশো শতাংশ প্রতিরোধ করা যায়। সারানোর কোনো উপায় নেই। ব্যবস্থা সব আছে।সচেতনতার অভাবে ভুক্তভোগী একটা পরিবার।
হাসির মা এসেছিল একটু আগে। ঘুমাচ্ছে বলে আর ডাকতে দিই নি। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেছে হাসির মা।যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করেছিল হাসি কেমন আছে ডাক্তার বাবু। অপ্রিয় হলেও সত্যি কথা গুলো বলতে হয়। এই অসহ্য কাজটা দিনের পর দিন করতে হয় আমাদের। "এবারে কিন্তু অবস্থা একটু বেশি খারাপের দিকে। রক্ত এত কম যে হার্ট অতোটা চাপ নিতে পারেনি।এবারে ওর হার্ট ফেল করেছে। তাই এত শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। রক্ত তো চলছেই। কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে হার্টের চাপ কমানোর জন্য।দেখা যাক "
এই দেখা যাক কথাটা খুব গোলমেলে। ওষুধ দিয়ে বসে থাকা। ছিপ ফেলে মাছ ধরার মত। নিশ্চয়তা নেই আশা আছে শুধু। কখনও সে আশা সবাইকে চমকে দিয়ে হত হয়ে যায় বেমালুম। কখনও ব্যাখ্যা থাকে কিছু করার থাকে না। কখনও কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। তবুও যতক্ষণ শ্বাস, যতক্ষণ নাড়ি টিক টিক করে ততক্ষণ আশা আঁকড়ে বসে থাকা।
পাঁচিলের ধারে একটা হাসনুহানার গাছ ছিল আমাদের। এখন ফুলফোটার সময় নয় তবুও আজ দেখলাম একটা কুঁড়ি ফুটেছে। ফুল থেকে ফুলের নাম টা আমার খুব ভালো লাগে। তিনদিন হলো বিশেষ কাজে ছুটিতে।বাড়িতে আসলে কিছুটা স্বস্তি। কিছুটা মুক্ত বাতাস। মনিটরের ক্রমাগত সাইরেনের আওয়াজ থেকে অনেক টা দুর। তবুও রাতে শুতে গেলে টিং টিং করে আওয়াজ কানের ভেতর বেজে যায়। নিরবচ্ছিন্ন আওয়াজ।
ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।সাড়ে নটা। বাড়িতে আসলে এই একটা বিষয়ে কেউ তাড়া দেয় না। জানালার পর্দা টেনে মা যথাসম্ভব দিনের আলোকে আড়াল করে রেখেছে। ফোনটা নিয়ে দেখলাম পাঁচটা মিসড কল। হসপিটালের সেল ফোন থেকে। বাড়িতে আসলে সাধারণত ফোন আসেনা। খুব বিশেষ দরকার ছাড়া। তাহলেও একবার বা দুবার। সকাল পাঁচটায় পরপর পাঁচ খানা মিসড কল কিছুটা অবাক করেছে। হাসির ছুটি হবার কথা ছিল দু একদিনের মধ্যে। এবারের মত সামলে গেছে দেখে নিশ্চিন্তে বাড়ি এসেছিলাম। তাহলে ব্যাপার কি!
হ্যালো !
ওপার থেকে নাগাড়ে যা বলে গেলো অন ডিউটি সিস্টার তার তর্জমা খানিকটা এরকম...
হাসির ছুটি হবার কথা ছিলো গত পরশু কিন্তু রাতে প্রচন্ড জ্বর আসার জন্য পরেরদিন সকালে ছুটি হয়নি। ব্লাড টেস্ট সেপসিস ধরা পড়েছে। জ্বর কিছুতে কমছিলো না। গত ভোরে প্রচন্ড জ্বর শ্বাসকষ্ট। ভুল বকছিলো। হাসনুহানা , শাবির , ডাক্তার কাকু এরকম কিছু কথা বলছিল। বা বলা ভালো বলার চেষ্টা করছিলো...তারপর সব শেষ। সি সি ইউ কেবিনের এক নম্বর বেডের হাসনুহানা খাতুন ওরফে হাসি বাল্য বন্ধু সাবিরকে ছেড়ে চলে গেছে নিরুদ্দেশের দেশে।
মনে পড়লো আসার দিন আমাকে ডেকে বলেছিল "তোমাকে বলেই দি কাকু। তুমি তো আমার বন্ধু। শাবির কে একটা হাসনুহানা চারা দেবো। ওকে বলেছিলাম আমি জানি আমি বেশিদিন বাঁচবো না। আগেরবার যখন এসেছিলাম একটা সিস্টার আন্টি বলেছিলো । তাই আমি যখন থাকবো না হাসনুহানার সাথে খেলা করবে কথা বলবে। কেমন হবে বলো! দারুন না!"
কি বলতাম উত্তরে! কাজের ছুতোয় উঠে এসেছিলাম ভেজা চোখ দুটো আড়াল করে। সকাল আসতে আসতে দুপুরের দিকে বাঁক নিচ্ছে। পাঁচিলের দিকে তাকালাম। একটা দোয়েল লাফাচ্ছে। লেজ নাড়ছে। একটা বেনেবউ। তিনটে শালিক। শুধু গতদিনের অকালে ফোটা হাসনুহানার কুঁড়ি টা চোখে পড়লো না।
No comments:
Post a Comment